কথায় কথায় তিয়োনা একদিন কাতেরিনাকে বলল, তুমি আমাকে নিয়ে নালিশ করছিলে না? কিন্তু আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। আমারটা ছিল আজ-আছে-কাল-নেই ধরনের দৈবাৎ ঘটে যাওয়ার একটা ব্যাপার; এসেছিল, চলে গেল, মিলিয়ে গেল; কিন্তু সাবধান, এই সোনেৎকাটার ওপর নজর রেখ।
কাতেরিনা মনস্থির করে আপন মনে বলল, জাহান্নমে যা আমার এই আত্মসম্মান; আজই আমি তার সঙ্গে মিটমাট করে ফেলব। এবং তার পর ওই একটিমাত্র চিন্তা নিয়ে পড়ে রইল, মিটমাট করে ফেলার জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশলটা কী হবে?
কিন্তু কিছু করতে হল না; সেরগেই নিজেই তাকে এই ধাঁধা থেকে বেরোবার পথ তৈরি করে দিল।
পরের আশ্রয়ে পৌঁছতেই সেরগেই কাতেরিনাকে ডেকে বলল, ভা, আজ রাত্রে এক মিনিটের তরে আমার কাছে এসো তো; তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কাতেরিনা চুপ করে রইল।
কী হল? আমার ওপর এখনও রেগে আছ নাকি? কথা বলবে না?
কাতেরিনা এবারেও কোনও সাড়া দিল না।
কিন্তু পরের ঘাঁটির কাছে আসার সময় শুধু সেরগেই না, সবাই লক্ষ করল যে, কাতেরিনা সরদার পাহারাওলার চতুর্দিকে ঘুর ঘুর করছে, শেষটায় ভিক্ষায় পাওয়া তার সতেরোটি কপেক সে সরদারের হাতে গুঁজে দিল। মিনতিভরা কণ্ঠে তাকে বলল, আরও দশটা জমাতে পারলেই তোমাকে দেব।
সরদার পয়সা কটি আস্তিনের ভঁজে লুকল। বলল, ঠিক আছে।
লেনদেন শেষ হয়ে গেলে সেরগেই ঘোঁৎ করে খুশি প্রকাশ করে সোনেৎকার দিকে। চোখের ইশারা মারল।
ঘাঁটির সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে কাতেরিনাকে জড়িয়ে ধরে আর সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ওগো, কাতেরিনা, লক্ষ্মীটি, শুনছিস ছোঁড়ারা, এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন মেয়ে তো সারা সংসারেও পাওয়া যায় না।
কাতেরিনার মুখ লাল হয়ে উঠল– আনন্দে সে তখন হাঁফাচ্ছে।
সন্ধ্যা হতে না হতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল; একলফে সে বেরিয়ে এল বললে কমই বলা হয়; তার সর্বাঙ্গ তখন ঘন ঘন শিহরিত হচ্ছে আর অন্ধকারে তার হাত সেরগেইয়ের সন্ধানে এখানে-ওখানে খুঁজছে।
তাকে আলিঙ্গন করে আপন বুকে চেপে যেন দম বের করে সেগেই বলল, আমার কেট।
চোখের জলের ভিতর দিয়ে কাতেরিনা উত্তর দিল, ওগো, আমার সর্বনাশের নিধি। তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সে যেন ঝুলে রইল।
পাহারাওলা করিডরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি পাইচারি করতে করতে মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছিল; বুটজুতোর ডগায় থুথুর তীর ছোঁড়া অভ্যাস করে ফের পাইকারি আরম্ভ করছিল; ক্লান্তিতে জীর্ণ কয়েদিরা দরজার ভিতরে নাক ডাকিয়ে যাচ্ছে; ঘর গরম করার স্টোভের নিচে কোথায় যেন একটা ইঁদুর কুট কুট করে কম্বল কাটছে; ঝিঁঝির দল একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রাণপণ চিৎকার করে যাচ্ছে–কাতেরিনা তখনও সপ্তম স্বর্গে।
কিন্তু হৃদয়াবেগ ভাবোচ্ছ্বাস স্তিমিত হল এবং রসকষহীন অনিবার্য বাক্যালাপ আরম্ভ হল।
করিডরের এক কোণে মেঝের উপর বসে সেরগেই নালিশ জানাল, আমি কী মারাত্মক যন্ত্রণায়ই না কষ্ট পাচ্ছি; পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু অবধি হাড়গুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমায় পাগল করে তুলেছে।
সেরগেইয়ের লম্বা কোটের ভিতর সোহাগভরে মাথা গুঁজে কাতেরিনা শুধাল, তা হলে কী করা যায়, সেরেজেশ্বকা?
যদি না… কী জানি, হয়তো-বা ওদের বলতে হবে, কাজানে পৌঁছলে আমাকে সেখানকার হাসপাতালে জায়গা করে দিতে। তাই করব নাকি?
সে কী? কী যে বলছ, সেরেজা!
এছাড়া অন্য কী গতি আছে বল; যন্ত্রণায় আমার যে প্রাণ যায়।
কিন্তু তা হলে তারা তো আমাকে আগে আগে খেদিয়ে নিয়ে যাবে, আর তুমি পড়ে রইবে পিছনে!
ঠিক কথা, কিন্তু আমি কী করি? আমি তোমাকে বললুম তো, পায়ের শিলি ঘষে ঘষে আমাকে যে মেরে ফেলল। শিকলিগুলো যেন ঘষতে ঘষতে আমার হাড়গুলোর ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। হয়তো-বা কয়েকদিনের জন্য মেয়েদের লম্বা পশমের মোজা পরলে কিছু-একটা হয়।
লম্বা মোজা? আমার কাছে এখনও আনকোরা একজোড়া তো রয়েছে, সেরেজা!
তা হলে তো আর কথাই নেই।
একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে কাতেরিনা ছুট দিয়ে ঢুকল তার কুঠুরিতে। শোবার তক্তার নিচের থেকে হাতড়ে হাতড়ে বের করল তার ব্যাগটা। ফের ছুট দিল সেরগেইয়ের কাছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নীল রঙের পুরু পশমের একজোড়া লম্বা মোজা; দু পাশে রঙিন সিল্কের মিহিন নক্শা জ্বলজ্বল করছে–বক শহরের তৈরি মোজা, এ মোজা তৈরি করেই সে শহর তার ন্যায্য খ্যাতি পেয়েছে।
কাতেরিনার শেষ মোজাজোড়াটি নিয়ে যেতে যেতে সেরগেই জোর দিয়ে বলল, এগুলো পরলে আর ভাবনা কী!
কাতেরিনার কী আনন্দ! ফিরে এসে কঠিন তক্তায় অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। শুনতেই পেল না, সে ফিরে আসার পর সোনেৎকা করিডরে বেরিয়ে গেল আর সেখানে সমস্ত রাত কাটিয়ে চুপে চুপে ভোরের ঠিক অল্প একটু আগে কখন ফিরে এল।
এ সমস্ত ঘটল কাজান পৌঁছবার দু ঘাঁটি পূর্বে।
১৫. ঘাঁটির বন্ধ গুমোট ঘর
১৫.
ঘাঁটির বন্ধ গুমোট ঘরের দেউড়ি থেকে বেরুবামাত্রই কয়েদিদের রুদ্র অভ্যর্থনা জানাল শীতে জর্জর বৃষ্টি-বরফে মেশা অকরুণ দিবস। কাতেরিনা বেরিয়েছিল বুকে যথেষ্ট সাহস বেঁধে কিন্তু আপন সারিতে যোগ দেওয়া মাত্রই তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল, মুখের রঙ সবুজে পরিবর্তিত হয়ে গেল। তার চোখের সামনে বিশ্ব-সংসার অন্ধকার হয়ে গেল; তার প্রত্যেকটি হাড়ের জোড়া যেন তাকে ছুঁচের মতো খোঁচাতে আরম্ভ করল, যেন তার দুটি হাঁটু ভেঙে গেছে। ওই তার সামনে সোনেৎকা দেমাক করে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে পায়ের নীল পশমের মোজা– তার উপরের সিল্কের মিহিন কাজ– কাতেরিনা কত না ভালো করেই চেনে!