করিডরের মাত্র একটি জায়গায় অগভীর পিরিচের উপর ঢালাই মোমে প্রদীপের নিষ্প্রভ পলতেটি ক্ষীণ আলো দিচ্ছে। কাতেরিনা চলতে চলতে দু-তিনটি যুগল-মিলনের সঙ্গে ঠোক্কর খেল– গা মিলিয়ে দিয়ে তারা যতদূর সম্ভব অদৃশ্য হবার চেষ্টা করছিল। পুরুষদের ওয়ার্ড পেরিয়ে যাবার সময় কাতেরিনা শুনতে পেল তাদের দরজায় কাটা ছোট জানালার ভিতর দিয়ে চাপা হাসির শব্দ আসছিল।
পাহারাওলা বিড়বিড় করে কাতেরিনাকে বলল, হাসাহাসির রকমটা দেখছ? তার পর তার কাঁধে ধরে একটা কোণের দিকে ঠেলে দিয়ে চলে গেল।
হাতড়াতে গিয়ে কাতেরিনার একটা হাত পড়ল কর্কশ কোট আর দাড়ির উপর, দ্বিতীয় হাতটা স্পর্শ করল কোন এক রমণীর গরম মুখের উপর।
সেরগেই নিচু গলায় শুধল, কে?
কী, কী করছ তুমি এখানে? তোমার সঙ্গে এ কে?
অন্ধকারে কাতেরিনা সজোরে তার সপত্নীর মাথা বাঁধার রুমালখানা ছিনিয়ে নিল। সে-ও সঙ্গে সঙ্গে তাকে এড়িয়ে দিল ছুট। করিডরে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে সে বায়ুবেগে অন্তর্ধান করল।
সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের ওয়ার্ড থেকে উচ্চকণ্ঠে ফেটে উঠল একশো অট্টহাস্য!
কাতেরিনা ফিসফিসিয়ে বলল, বদমাইশ, আর সেরগেইয়ের নবীন নাগরীর মাথা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রুমালের কোণ দিয়ে মারল তার মুখে ঝাঁপটা। সেরগেই তার দিকে হাত তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে-ও ইতোমধ্যে ছায়ার মতো লঘুপদে করিডর দিয়ে ছুটে গিয়ে ধরেছে তার কুঠুরির হাতল। পুরুষদের ওয়ার্ড থেকে যে অট্টহাস্য তার পিছনে পিছনে ধাওয়া করেছিল সেটা আবার এমনি কলরবে ধ্বনিত হল যে, যে-পাহারাওয়ালাটা পিরিচের গালামোমের কাঁপা কাঁপা বাতিটার সামনে বসে সময় কাটাবার জন্য আপন বুটজুতোর ডগাটাকে লক্ষ করে মুখ থেকে থুথুর তীর ছুড়ছিল সে পর্যন্ত মাথা তুলে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠল, চোপ্ ব্যাটারা!
কাতেরিনা চুপচাপ শুয়ে পড়ে অবধি সামান্যতম নড়াচড়া না করে সেইরকমই পড়ে রইল। সে চাইছিল নিজেকে বলে, আমি তাকে আর ভালোবাসিনে– আর অনুভব করছিল তাকে সে ভালোবাসে আরও গভীরভাবে, আরও বেশি আবেগভরা উচ্ছ্বাসে। বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই একই ছবি: তার ডান হাত অন্যটার মাথার নিচে থেকে থেকে কাঁপছে, তার বাঁ হাত চেপে ধরেছে অন্যটার কামাগ্নিতে জ্বলন্ত স্বন্ধদ্বয়।
হতভাগিনী কাঁদতে আরম্ভ করল। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে সর্ব দেহ-মন দিয়ে কামনা করতে লাগল, ওই সেই হাতটি যেন থাকে তার মাথার নিচে, সেই হাতটি যেন চেপে ধরে তার কাঁধ- হায়, সে কাঁধ এখন মৃগী রোগীর মতো থেকে থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে।
সেপাইয়ের বউ তিয়োনা তাকে ভোরবেলা জাগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি অন্তত আমার রুমালখানা ফেরত দিতে পার!
ও! তুমিই ছিলে তবে?
লক্ষ্মীটি, দাও না ফেরত!
কিন্তু তুমি আমাদের মাঝখানে আসছ কেন?
কেন, আমি কী করছি? তুমি কি ভেবেছ আমাদের ভিতর গভীর প্রণয়, নাকি? না এমন কিছু সত্যি একটা মারাত্মক ব্যাপার যে যার জন্য তুমি রেগে টং হবে!
কাতেরিনা একটুখানি চিন্তা করে বালিশের তলা থেকে আগের রাত্রের ছিনিয়ে নেওয়া রুমালখানা বের করে তিয়োনার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ ফেরাল।
তার হৃদয় হালকা হয়ে গেল।
আপন মনে বললে, ছিঃ! আমি কি এই রঙ-করা পিপেটাকে হিংসে করব? চুলোয় যাক গে ওটা। তার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতেই আমার ঘেন্না ধরে।
পরের দিন পথে যেতে যেতে সেরগেই তাকে বলতে লাগল, শোন, কাতেরিনা ভভূনা, তোমাকে আমি কী বলতে চাই। দয়া করে তুমি তোমার মাথার ভিতর এই তত্ত্ব-কথাটি ভালো করে ঢুকিয়ে নাও তো যে, প্রথমত আমি তোমার জিনোভিই বরিসি নই, দ্বিতীয়ত তুমি এখন আর কোনও গেরেম্ভারি সদাগরের বউ নও; সুতরাং মেহেরবানি করে এখন আর বড়মানষির চাল মারবে না। আমার ব্যাপারে আস্ত একটা পাঁঠীর মতো যত্রতত্র ছুঁ মারলে সেটা আমি বরদাস্ত করব না।
এর উত্তরে কাতেরিনা কিছু বলল না এবং তার পর এক সপ্তাহ ধরে সে সেরগেইয়ের পাশে পাশে হাঁটল বটে, কিন্তু উভয়ের মধ্যে একটিমাত্র দৃষ্টি বা বাক্য-বিনিময় হল না। তাকেই করা হয়েছে আঘাত, তাই সে নিজের মর্যাদা বাঁচিয়ে তার এই সেরগেইয়ের সঙ্গে তার এই সর্বপ্রথম কলহ মিটিয়ে সমঝাওতা আনার জন্য তার দিকে এগিয়ে যেতে চাইল না।
এদিকে যখন সেরগেইয়ের প্রতি কাতেরিনার রাগ, ততদিনে সেরগেই কুলধবলা তন্বী সোনেৎকার দিকে হরিণের মতো কাতর নয়নে তাকাতে আরম্ভ করেছে এবং নর্মভরে তার হৃদয়-দুয়ারে প্রথম করাঘাত আরম্ভ করে দিয়েছে। কখনও সে তার সামনে নম্রতাভরে মাথা নিচু করে বলে, আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিবাদন আর কখনও-বা তার দিকে তাকিয়ে মধুর স্মিত হাস্য করে, আর পাশাপাশি এলে ছল করে তাকে হাত দিয়ে ঘিরে দেয় সোহাগের চাপ। কাতেরিনা সবকিছুই লক্ষ করল, আর তার বুকের ভিতরটা যেন আরও সিদ্ধ হতে লাগল।
মাটির দিকে না তাকিয়ে যেন ধাক্কা খেতে খেতে এগুতে এগুতে কাতেরিনা তোলপাড় করতে লাগল, কী জানি, তবে কি ওর সঙ্গে মিটিয়ে ফেলব? কিন্তু এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বাধা দিতে লাগল তার আত্মসম্মান– এগিয়ে গিয়ে মিটমাট করে ফেলতে। ইতোমধ্যে সেরগেই আরও নাছোড়বান্দা হয়ে সেঁটে রইল সোনেৎকার পিছনে; এবং সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, নাগালের বাইরের যে-সেনোক্তা এতদিন পাক দিতেন মোচড় খেতেন কিন্তু ধরা দিতেন না, এইবারে তিনি, যে কোনও কারণেই হোক, হঠাৎ যেন পোষ মেনে নিচ্ছেন।