কাতেরিনা তার ছিটের তৈরি ব্যাগে করে মূল্যবান জিনিস সঙ্গে নিয়েছিল অল্পই, এবং রোক টাকাকড়ি নিয়েছিল তার চেয়েও কম। এবং সেসবও খর্চা হয়ে গেল নিনি নগরদ*[* বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মাসি গর্কির নামে বর্তমান গর্কি।] পৌঁছবার বহু পূর্বেই পাহারাওলাদের ঘুষ দিতে দিতে– যাতে করে সে রাস্তায় সেরগেইয়ের পাশে পাশে যেতে পারে, যাতে করে পথিমধ্যে রাত্রিযাপন আশ্রয়ের হিমশীতল এক কোণে, গভীর অন্ধকারে সে তার সেরগেইকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেক আলিঙ্গন করতে পারে।
ওদিকে কিন্তু কাতেরিনার কে-মার্কা মারা বল্লভের হৃদয়ে কী জানি কী করে তার প্রতি স্নেহ-প্রেম শুকিয়ে গিয়েছে। কথা সে বলত কমই, আর বললে মনে হত যেন আঁকশি দিয়ে কথাগুলো অতি কষ্টে টেনে বের করছে, আর এসব গোপন মিলনের মূল্য দিত সে অত্যল্পই– যার জন্য কাতেরিনাকে তার খাদ্য-পানীয়, আর তার আপন অত্যাবশ্যক প্রয়োজনের জন্য যে-কটি সামান্য দু-চার পয়সা তার তখনও ছিল, সবকিছু বিলিয়ে দিতে হত। এমনকি সেরগেই একাধিকবার বলতেও কসুর করল না, ওই যে অন্ধকার কোণে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিচের ধুলো সরাবার জন্য তুমি পাহারাওলাদের পয়সা দিচ্ছ সেগুলো আমাকে দিলেই পার।
মিনতিভরা কণ্ঠে কাতেরিনা বলল, আমি তো কুল্লে পঁচিশটি কপে দিয়েছি, সেরেজেঙ্কা।
আর পঁচিশটি কপেক কি পয়সা নয়? পঁচিশটি কপেক্ কি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া যায়? অতগুলো কপে কবার পেয়েছ তুমি? ওদিকে কবার অতগুলো তুমি দিয়ে দিয়েছ, কে জানে।
কিন্তু ওই করেই তো আমরা একে অন্যকে দেখতে পাই।
বটে? সেটা কি সহজ? ওতে করে আমরা কী আনন্দ পাই– এতসব নরক-যন্ত্রণার পর? আমার তো ইচ্ছে করে আমার জীবনটাকে পর্যন্ত অভিসম্পাত করি, আর এ ধরনের মিলনের ওপর তো কথাই নেই।
কিন্তু সেরেজা, তোমাকে দেখতে পেলে আমার তো অন্য কোনও কিছুতেই এসে-যায় না।
এসব ঘোর আহাম্মকি।– এই হল সেরগেইয়ের উত্তর।
এসব উত্তরে কাতেরিনা কখনও আপন ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে রক্ত বের করত, আর কখনও-বা নিশাকালীন মিলনের অন্ধকার অশ্রুবর্ষণে অনভ্যস্ত তার সে দুটি চোখও তিক্ততার তীব্র বেদনায় ভরে যেত, কিন্তু সে সবকিছু বরদাস্ত করে গেল, নীরবে যা ঘটার ঘটতে দিল এবং নিজেকে নিজে ফাঁকি দিতে কসুর করল না।
উভয়ের মধ্যে এই নতুন এক সম্পর্ক নিয়ে তারা নিজনি নগর পৌঁছল। এখানে পৌঁছে তারা আরেক দল কয়েদির সঙ্গে যোগ দিল– তারা এসেছে মস্কো অঞ্চল থেকে, যাবে ওই একই সাইবেরিয়ায়।
নবাগত এই বিরাট বাহিনীর হরেক রকম চিড়িয়ার মাঝখানে, মেয়েদের দলে ছিল দুটি মেয়ে যারা সত্যই মনোযোগ আকর্ষণ করে। একটির নাম তিয়োনা, ইয়ারোস্লাভূলের এক সিপাইয়ের স্ত্রী। এরকম চমৎকার কামবিলাসিনী মোহিনী আর হয় না। সে লম্বা, আর আছে একমাথা চুলের ঘন কুন্তল বেণি, মদিরালস্ হরিদ্রাভ নয়ন, তার উপর নেমে এসে ছায়া দিচ্ছে নিবিড় আঁখিপল্লবের রহস্যময় অবগুণ্ঠন। অন্যটি সতেরো বছরের নিখুঁত খোদাই করা তরুণী। গাঁয়ের বর্ণটি মোলায়েম গোলাপি, মুখটি ছোট্ট, কচি তাজা দুটি গালের উপর দুটি টোল, আর কয়েদিদের মাথা-বাঁধবার ছিটের রুমালের নিচে থেকে কপালে নেমে এসে এখানে-ওখানে নাচছে ঢেউখেলানো সোনালি চুল। দলের সবাই তাকে সোনেৎকা নামে ডাকত।
সুন্দরী রমণী তিয়োনার স্বভাবটি ছিল শান্ত, মদিরালস। দলের সবাই তাকে ভালো করেই চিনত, এবং তাকে জয় করতে সক্ষম হয়ে কোনও পুরুষই অত্যধিক উল্লাসভরে নৃত্য করত না, কিংবা সে যখন তার তাবৎ কৃপাভিলাষীদের মস্তকে সমমূল্যের বিজয়-মুকুট পরিয়ে দিত তখন অত্যধিক শোকেও কেউ মুহ্যমান হত না।
পুরুষ-কয়েদির দল মশকরার সুরে সমস্বরে বলত, মেয়েদের ভিতর আমাদের তিয়োনা পিসি সবচেয়ে দরদি দিল ধরেন; কারও বুকে তিনি কস্মিনকালেও আঘাত দিতে পারেন না!
সোনেৎকা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ঝোপের চিড়িয়া।
তার সম্বন্ধে তারা বলত, যেন বান্ মাছ পাক দেবে, মোচড় খাবে, কিন্তু কখনও শক্ত মুঠোয় ধরতে পারবে না।
সোনেৎকার রুচি ছিল; চট করে যা-তা সে তো নিতই না, বরঞ্চ বলা যেতে পারে, বাড়াবাড়িই করত। সে চাইত কাম যেন তার সামনে ধরা হয় সাজসজ্জায় যেন সাদামাটা তরি-তরকারি তার সামনে না ধরে সেটা যেন তৈরি হয় তীক্ষ্ণ স্বাদের ঝাল-টকের সস্ দিয়ে কামে যেন থাকে হৃদয়দহন, আত্মত্যাগ। আর তিয়োনা ছিল খাঁটি, নির্ভেজাল রুশ সরলতার নির্যাস। আর সে সরলতায় ভরা থাকত এমনই অলসের আবেশ যে, কোনও পুরুষকে, কেন জ্বালাচ্ছ, ছেড়ে দাও আমাকে বলবার মতো উৎসাহ তার ছিল না। সে শুধু জানত, সে স্ত্রীলিঙ্গের রমণী। এ জাতীয় রমণীকে বড়ই আদর করে ডাকাত-ডাকু, কয়েদির দল আর পেতেসবুর্গের সোশ্যাল-ডেমোক্রাটিক গুষ্ঠী।
এই দুই রমণীসহ মস্কো থেকে আগত কয়েদির দল যখন সেরগেই-কাতেরিনার দলের সঙ্গে মিলিত হল তখন এ দুটি রমণী নিয়ে এল কাতেরিনার জীবনে ট্র্যাজেডি।
.
১৪.
দুই দলে সম্মিলিত হয়ে নিজনি থেকে কাজান রওনা হওয়ার প্রথমদিন থেকেই সেরগেই কোনওপ্রকারের ঢাক-ঢাক গুড়গুড় না করে উঠে-পড়ে লেগে গেল সৈনিক বধূ তিয়োনার প্রণয়লাভের জন্য এবং স্পষ্টই বোঝা গেল কোনওপ্রকারের অলঙ্ঘ্য প্রতিবন্ধক তার সামনে। উপস্থিত হয়নি। অলসাবেশা তিয়োনা সেরগেইকে অযথা হতাশায় মনমরা হতে দিল না– সে তার হৃদয়বশত কদাচ কোনও পুরুষকেই হতাশায় মনমরা হতে দিত না। তৃতীয় কিংবা চতুর্থ রাত্রির আশ্রয়স্থলে সন্ধ্যার সময় কাতেরিনা ঘুষ দিয়ে তার সেরেজেকার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিল; এখন সে ন্দ্রিাহীন চোখে প্রতীক্ষা করছিল, যে কোনও মুহূর্তে প্রহরী এসে আস্তে আস্তে তাকে নাড়া দিয়ে কানে কানে বলবে, ছুটে যাও! ঝটপট সেরে নিয়ো। দরজা খুলে গেল, আর কে যেন, কোন এক রমণী তীরবেগে করিডর পানে ধাওয়া করল; দরজা আবার খুলে গেল, আবার আরেক রমণী তিলার্ধ নষ্ট না করে তার শোবার তক্তা থেকে লাফ দিয়ে উঠে প্রহরীর পিছনে অন্তর্ধান করল; অবশেষে কে যেন এসে তার সর্বাঙ্গ ঢাকা কর্কশ কোটে আস্তে আস্তে টান দিল। তৎক্ষণাৎ সে তার শোবার তক্তা থেকে লাফ দিয়ে উঠল– তক্তাখানা কত না কয়েদির গাত্ৰ-ঘর্ষণে চিকুণ-মসৃণ হয়ে গিয়েছে– কোটটা কাঁধের উপর ফেলে আস্তে আস্তে প্রহরীর গায়ে ধাক্কা দিল তাকে গন্তব্যস্থল দেখিয়ে দেবার জন্য নিয়ে যেতে।