তখনও তার লাশ সম্পূর্ণ পচে যায়নি; সেটা খুঁড়ে তুলে একটা বিরাট সাইজের কফিনে রাখা হল। সর্বসাধারণকে ত্রাসে আতঙ্কিত করে সে তার দুটি পাপের সহকর্মিণীরূপে যুবতী গৃহকত্রীর নাম উল্লেখ করল।
সর্ব প্রশ্নের উত্তরে কাতেরিনা লভভূনার মাত্র একটি উত্তর : আমি কিছু জানিনে; আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানিনে।
সেরগেইকে কাতেরিনার সামনে মুখোমুখি করে তাকে দিয়ে কাতেরিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ানো হল। তার সব স্বীকৃতি শুনে কাতেরিনা নীরব বিস্ময়ে তার দিকে তাকাল– সে দৃষ্টিতে কিন্তু কোনও রোষের চিহ্ন ছিল না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, সে যখন সবকিছু বলার জন্য এতই উৎসুক তখন আমার কোনও কিছু অস্বীকার করে আর কী হবে? আমি তাদের খুন করেছি।
সবাই শুধল, কিন্তু কেন, কিসের জন্য?
কাতেরিনা সেরগেইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ওর জন্য।
সেরগেই মাথা হেঁট করল।
আসামি দুজনাকে জেলে পোরা হল। এই বীভৎস কাণ্ডটা জনসাধারণের ভিতর এমনই কৌতূহল, ঘৃণা আর ক্রোধের সঞ্চার করেছিল যে, ঝটপটু তার ফয়সালা হয়ে গেল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে সেরগেই এবং তৃতীয় বণিক সঙ্রে জনৈক বণিকের বিধবা কাতেরিনা লুভভনাকে ফৌজদারি আদালতের রায় শোনানো হল : তাদের আপন শহরের খোলা হাটে প্রথম তাদের চাবুক মারা হবে এবং তার পর সাইবেরিয়াতে কঠিন সশ্রম কারাদণ্ডে উভয়ের নির্বাসন। মার্চ মাসের এক ভোরবেলাকার নিদারুণ হিমের শীতে চাবুকদার কাতেরিনার অনাচ্ছাদিত দুগ্ধধবল পৃষ্ঠে আদালতের স্থির করা সংখ্যা গুনে গুনে চাবুকের ঘা মেরে মেরে নীল-লাল রঙের উঁচু ফুলে-ওঠা দাগড়ার দাগ তুলল। তার পর সেরগেই পিঠে-কাঁধে তার হিস্যে পেল। সর্বশেষে তার সুন্দর মুখের উপর জ্বলন্ত লোহা দিয়ে তিনটি রেখা কেটে ভ্রাতৃহন্তা ‘কেন’-এর লাঞ্ছনা অঙ্কন করে দিল।*[* বাইবেলের প্রথম অধ্যায় সৃষ্টি পর্বে বর্ণিত আছে, আদমের পুত্র কে তার ভ্রাতা আবেলকে হত্যা করে; যেহেতু মানুষ মাত্রই একে অন্যের ভ্রাতা তাই খুনির কপালে ছ্যাকা দিয়ে তিনটি চিরস্থায়ী লাঞ্ছন অঙ্কনের বর্বর প্রথা ইউরোপের প্রায় সর্বদেশেই উনবিংশ শতাব্দী অবধি প্রচলিত ছিল।]
এসব ঘটনা ঘটার সময় আগা-গোড়া দেখা গেল, যে কোনও কারণেই হোক, সেরগেই কিন্তু কাতেরিনার চেয়ে জনসাধারণের বেশি সহানুভূতি পেল। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত অবস্থায় কৃষ্ণবর্ণ দণ্ডমঞ্চ থেকে নামবার সময় সে বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, পক্ষান্তরে কাতেরিনা নেমে এল দৃঢ় পদক্ষেপে তার একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল যাতে করে তার খসখসে শেমিজ আর কয়েদিদের কর্কশ কোটটা তার পিঠে সেঁটে না যায়।** [** অনুবাদকের মনে হয়, তার ভয় ছিল, কর্কশ উলের সুতো পিঠের ঘায়ে ঢুকে গেলে শুকোবার সময় সমস্ত পিঠের চামড়া অসমান হয়ে গিয়ে তার পিঠের মসৃণ সৌন্দর্য নষ্ট করবে। কিন্তু অতি অবশ্য মনে রাখা উচিত, সে শুধু তার বল্লভের ভোগের জন্য। আপন সৌন্দর্য নিয়ে কাতেরিনার নিজস্ব কোনও দম্ভ ছিল না– কাহিনীতে তার কোনও চিহ্ন নেই।]
এমনকি জেল-হাসপাতালে যখন তাকে তার সদ্যোজাত শিশুকে দেখানো হল সে মাত্র এইটুকু বলল, আহ, কে ওটাকে চায়? কস্মিনকালেও গোঙরানো কাতরানোর একটি মাত্র শব্দ না করে, কস্মিনকালেও কারও বিরুদ্ধে কণামাত্র অভিযোগ না জানিয়ে সে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শক্ত তক্তার উপর বুকের ভার রেখে কুঁকড়ে পড়ে রইল।
.
১৩.
সেরগেই ও কাতেরিনা অন্যান্য কয়েদির সঙ্গে দল বেঁধে সাইবেরিয়ার উদ্দেশ্যে বেরোল বসন্ত ঋতুতে। পঞ্জিকায় সেটা বসন্ত ঋতু বলে লেখা আছে বটে, কিন্তু আসলে তখন সেই প্রবাদটাই সত্য যে, সূর্য আলোক দেন যথেষ্ট, কিন্তু গরমি দেন অতি অল্পই।
কাতেরিনার বাচ্চাটাকে বরিস তিমোতেইয়েভিচের সেই বুড়ি মামাত বোনের হাতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেওয়া হল। কারণ সে দণ্ডিতা রমণীর নিহত স্বামীর আইনসম্মত সন্তানরূপে স্বীকৃত হল বলে এখন সে ইসমাইল এবং ফেদিয়ার তাবৎ সম্পত্তির একমাত্র স্বত্বাধিকারী। এ ব্যবস্থাতে কাতেরিনা যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিল এবং বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিল পরিপূর্ণ তাচ্ছিল্যভরে। বহু অবাধ প্রণয়াবেগবিহ্বল রমণীর মতো তার প্রেমও আপন দয়িতে অবিচল হয়ে রইল– দয়িতের সন্তানে সঞ্চারিত হল না।
আর শুধু বাচ্চাটার ব্যাপারেই নয়, সত্য বলতে কী, কাতেরিনার জীবনে এখন আর কোনওকিছুর অস্তিত্ব নেই, আলো নেই, অন্ধকারও নেই; না আছে অমঙ্গল, না আছে মঙ্গল, দুঃখ নেই সুখও নেই, সে কিছুই বুঝতে পারে না, কাউকে ভালোবাসে না– নিজেকে পর্যন্ত না। অস্থির হয়ে সে শুধু প্রতীক্ষা করছিল একটি জিনিসের : কয়েদির দল রওনা হবে কবে, কারণ তার হৃদয়ে তখন একমাত্র আশা, দলের ভিতর সে সেরগেইকে আবার দেখতে পাবে। আপন শিশুটির কথা ততদিনে সে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছে।
তার আশা তাকে ফাঁকি দিল না। মুখে কে-এর লাঞ্ছনা আঁকা, সর্বাঙ্গে ভারী শিকল বয়ে সেরগেইও রওনা দিল তারই সঙ্গে একই ছোট দলটাতে।
যতই ঘৃণ্য হোক না কেন, মানুষ সর্ব অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় এবং সর্ব অবস্থাতেই নিজ নিজ ক্ষুদ্র আনন্দের সন্ধান সাধ্যমতো করে থাকে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার প্রয়োজন, কণামাত্র প্রয়োজন, কাতেরিনার ছিল না। সে সেরগেইকে আবার দেখতে পাচ্ছে এবং তার সঙ্গ পাওয়ার ফলে এই যে রাস্তা তাকে কঠিন কারাগারের নির্বাসনে নিয়ে যাচ্ছে সে-রাস্তাও তার কাছে আনন্দ-কুসুমে পুষ্পচ্ছাদিত বলে মনে হতে লাগল।