বছরের বারোটা প্রধান পর্বের যে কোনওটির আগের রাতে কাতেরিনা ভদের শহরের হাজার হাজার লোক শহরের সবকটা গির্জা ভরে দিত। শহরটা যদিও মফস্বলের, তবু তার ব্যবসাবাণিজ্য শিল্পোৎপাদন নগণ্য নয়। ফলে যেসব গির্জায় ভোরবেলাকার ঈশ্বরের-সংযোগ উপাসনা করা হত সেখানে এমনই প্রচণ্ড ভিড় জমত যে, বলতে গেলে পোকামাকড়টিও সেখানে নড়াচড়া করার মতো জায়গা পেত না। এসব গির্জের সমবেত ধর্মসঙ্গীত গাইত শহরের বণিক সম্প্রদায়ের তরুণের দল। তাদের মূল-গায়েন, আপন ওস্তাদও সেখানে নিযুক্ত থাকত।
আমাদের শহরবাসীরা প্রভুর গির্জার প্রতি অনুরক্ত উৎসাহী ভক্ত– তাই তাদের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তারা সঙ্গীত ও অন্যান্য কলার সমঝদার। গির্জায় বৈভব-উজ্জ্বল চাকচিক্য এবং অর্গেনসহ বহু কণ্ঠে গীত সঙ্গীত তাদের জীবনের একটি উচ্চতম পবিত্রতম বিমলানন্দ। যে গির্জায় যেদিন ঐক্যসঙ্গীত হত সেখানে আধখানা শহরের ভিড় লেগে যেত, বিশেষ করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের তরুণ দলের, কেরানি-কুল, ছোকরার দল, ফুলবাবুর পাল, কল-কারখানার ছোট বড় হুনুরি-কারিগর, এমনকি মিল কারখানার মালিকরাও তাঁদের ভামিনীগণ সমভিব্যাহারে উপস্থিত হতেন। সবাই ভিড় লাগাত একই গির্জায় : সবাই চাইত যে করেই হোক অৰ্গেনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অষ্ট কণ্ঠ-সঙ্গীত, কিংবা কোনও ওস্তাদ যখন সপ্তমে উঠে কঠিন কারুকার্য করেন সেগুলো শুনতে– তা সে নরকের অগ্নিকুণ্ডের গরম দিনেই হোক, আর পাথর-ফাটা কনকনে শীতেই হোক; গির্জার ঢাকা আঙিনাতেই হোক, আর জানালার নিচে দাঁড়িয়েই থোক।
ইসমাইলফদের পাড়ার গির্জেয় হবে সর্বমঙ্গলময়ী কুমারী মা-মেরির স্মরণে পরব। তাই তার আগের রাত্রে যখন ইসমাইল পরিবারে ফেদিয়াকে নিয়ে পূর্ববর্ণিত নাটক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তখন তাবৎ শহরের তরুণদল ওই গির্জেয় জড় হয়েছিল। গির্জে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বেশ শোরগোল তুলে তারা সে সন্ধ্যার বিখ্যাত তার-সপ্তক-গায়কের গুণ নিয়ে, এবং ওঁরই মতো সমান বিখ্যাত খাদ-গায়কের দৈব পদস্খলন নিয়ে আলোচনা করছিল।
কিন্তু সবাই যে কণ্ঠসঙ্গীত-আলোচনায় মেতে উঠেছিল তা নয়; দলের মধ্যে আর পাঁচজন আর পাঁচটা বিষয়ে অনুরাগী।
এদের মধ্যে ছিল একটি ছোকরা কলকজার হুনুরি। তাকে সম্প্রতি এখানকার একটি স্টিম-মিলের মালিক পেতের্সবুর্গ থেকে আমদানি করেছেন। ইসমাইলদের বাড়ির কাছে আসতে সে বলে উঠল, সবাই বলছে, মেয়েটা তাদের কেরানি সেরগেইকে নিয়ে রসকেলিতে অষ্টপ্রহর মেতে আছে।
ভেড়ার চামড়ার অস্তরদার নীল সুতি কোটপরা একজন বলল, যাহ! সে তো সব্বাই জানে। আর সেই কথাই যখন উঠল– আজ রাত্রে সে গির্জেয় পর্যন্ত আসেনি।
গির্জেয়? কী যে বলছ? বদমাইশ মাগীটা পাপের কাদামাটি এমনই সর্বাঙ্গে মেখেছে যে, সে এখন না ডরায় ভগবানকে, না ডরায় আপনি বিবেককে, না ডরায় দ্রজনের দৃষ্টিকে।
কলকজার ছোকরাটি বলল, ওই হোথা দেখ, ওদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। আঙুল তুলে সে দেখাল, খড়খড়ির ভিতর দিয়ে আসছে আলোর রেখা।
একাধিক গলা তাকে টুইয়ে দিয়ে বলল, ফাঁক দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখ না, এবারে তারা কোন তালে আছে।
দুই বন্ধুর কাঁধের উপর ভর করে কলকজার ছোকরাটি ফাঁকের ভিতর দিয়ে ভালো করে তাকাতে না তাকাতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ভাইরা সব, ওরা কার যেন দম বন্ধ করে তাকে মারছে– বন্ধুরা সব, দম বন্ধ করে কাউকে মারছে!
সঙ্গে সঙ্গে মরিয়া হয়ে দু হাত দিয়ে খড়খড়ির উপর থাবড়াতে লাগল। তার দেখাদেখি আরও জনা দশেক লাফ দিয়ে জানালার উপর উঠে হাতের মুঠো দিয়ে খড়খড়ির উপর হাতুড়ি পেটা করতে আরম্ভ করে দিল।
প্রতি মুহূর্তে ভিড় বাড়তে লাগল, এবং এই করেই ইসমাইলফুদের বাড়ি পূর্বোল্লিখিতভাবে আক্রান্ত হল।
***
ফেদিয়ার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে কলকজার লোকটি সাক্ষ্য দিল, আমি নিজে দেখেছি; আমি স্বচক্ষে দেখেছি; বাচ্চাটাকে চিত করে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে দুজনাতে মিলে তার দম বন্ধ করে মারছিল।
সেরগেইকে সেই রাত্রেই পুলিশ-থানায় নিয়ে যাওয়া হল; দুজন প্রহরী কাতেরিনাকে তার শোবার-ঘরে নজরবন্দি করে রাখল।
***
ইসমাইলদের বাড়িতে অসহ্য শীত ছেয়ে পড়েছে। ঘর গরম করার স্টোভগুলো জ্বালানো হয়নি, সদর দরজা সর্বক্ষণ খোলা, কারণ দঙ্গলের পর দঙ্গল কৌতূহলীর দল একটার পর আরেকটা বাড়ির ভিতরে এসে ঢুকছে। সবাই গিয়ে দেখছে কফিনের ভিতর শুয়ে ফেদিয়া– আরেকটা ডালা-বন্ধ পুরো মখমলের পর্দা দিয়ে ঢাকা বড় কফিন।*[* পরে বলা হয়েছে, এটাতে ছিল কাতেরিনার স্বামীর মৃতদেহ। এটা পচে গিয়েছিল বলে কফিনের ডালা বন্ধ করে তার উপর ভারী পর্দা ফেলে দেওয়া হয়েছিল– যাতে করে দুর্গন্ধ না বেরোয়।] ফেদিয়ার কপালের যেখানটায় ডাক্তার ময়নাতদন্তের জন্য কেটেছিলেন সেখানকার লাল দাগটি ঢাকার জন্য তার উপর রাখা হয়েছিল সাটিনের ফুল-পাতা দিয়ে তৈরি একটি মালা। তদন্তে প্রকাশ পায় যে, ফেদিয়া দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মারা যায়। সেরগেইকে ফেদিয়ার মৃতদেহের পাশে নিয়ে যাওয়ার পর, পাদ্রি ভয়াবহ শেষ বিচারের দিন এবং যারা কৃত পাপের জন্য অনুশোচনা করে না তাদের কী হবে সে সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলতে না বলতেই সে হাউ হাউ করে চোখের জলে ভেঙে পড়ল। সমস্ত প্রাণ খুলে দিয়ে সে যে ফেদিয়ার খুনি একথাই যে স্বীকার করল তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষা জানাল জিনোভিই বরিসিচের মরা লাশও যেন খুঁড়ে তোলা হয়– স্বীকার করল যে, পাদ্রি-কৃত শেষ-অন্ত্যেষ্টির পুণ্যফল থেকে জিনোভিইকে বঞ্চিত করে সে তাকে মাটিতে পুঁতেছিল।