সর্বশেষে নিবেদন, কয়েক মাস ধরে নিদ্রাকৃতায় ভুগি। তখন চিকিৎসক উপদেশ দেন, কোনও মৌলিক রচনায় হাত না দিয়ে যেন অনুবাদ-কর্ম আরম্ভ করি– তাতে করে রোগশয্যার একঘেয়েমি থেকে খানিকটে মুক্তি পাব। রোগশয্যার অজুহাত শুনে আমার অনুরাগী পাঠক (এ নিবেদনটি একমাত্র তাদেরই উদ্দেশে) যে অনুবাদ পছন্দ করে বসবেন, এ আশা আমার করা অনুচিত, কিন্তু কটু-কাটব্য করার সময় হয়তো সেকথা ভেবে খানিকটে ক্ষমার চোখে দেখবেন। এবং অতি সর্বশেষ নিবেদন, অনিদ্রারোগে অনুবাদকর্ম অতিশয় উপকারী। এটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বললুম। আমার মতো যারা অন্দ্রিায় ভুগছেন তারা উপকৃত হবেন। কিমধিকমিতি ॥
—সৈয়দ মুজতবা আলী
.
পাত্রপাত্রী
রুশ উপন্যাসে একই পাত্রকে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রপাত্রী ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে বলে নিম্নে তাদের নির্ঘণ্ট দেওয়া হল :
পরিবারের নাম –ইসমাইলফ
বাড়ির কর্তা — বরিস তিমোতেইয়েভিচ ইসমাইলফ, বরিস তিমোতেইয়েভিচ
পুত্র –জিনোভিই বরিসিচ
বরিসের পুত্রবধূ, জিনোভিইয়ের স্ত্রী –কাতেরিনা লভভনা ইসমাইলভা, কেট, কেতারিনা লভভনা, লভভনা
পুত্রবধূর প্রণয়ী –গেই ফিলিপচ, সেরেজকা, জেশকা, সেরেজেঙ্কা, সেরেজা
পাচিকা –সনিয়া
সম্পত্তির অংশীদার বালক –দর জাখাফর লিয়ামিন, ফেদিয়া
কয়েদি –য়োনা, সোনেৎকা ও অন্যান্য
.
.
০১.
মাঝে মাঝে আমাদের এই অঞ্চলে এমন সব নর-নারীর আবির্ভাব হয় যে, তার পর যত দীর্ঘকালই কেটে যাক না কেন, তাদের কথা স্মরণে এলেই যেন অন্তরাত্মা পর্যন্ত শিউরে ওঠে। এবং এদের মধ্যে নিশ্চয়ই পড়ে এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী, কাতেরিনা লভভূনা ইসমাইল। এর জীবন এমনই বীভৎস নাটকীয় রূপ নিয়েছিল যে, আমাদের সমাজের পাঁচজন ভদ্রলোক কোনও এক মশকরাবাজের অনুকরণে একে নাম দিয়েছিল, মৃৎসেন জেলার লেডি ম্যাকবেৎ।
কাতেরিনা তেমন কিছু অপূর্ব রূপসী ছিল না, কিন্তু চেহারাটি ছিল সত্যই সুশ্রী। তখন তার বয়েস সবে চব্বিশ; মাঝারি রকমের খাড়াই, ভালো গড়ন আর গলাটি যেন মার্বেল পাথরে কোদাই। ঘাড় থেকে বাহু নেমে এসেছে সুন্দর বাঁক নিয়ে, বুক আঁটসাঁট, নাকটি বাঁশির মতো শক্ত আর সোজা, শুভ্র উন্নত ললাট আর চুল এমনিই মিশমিশে কালো যে আসলে ওটাকে কালোয়-নীলে মেশানো বলা যেতে পারে। তার বিয়ে হয়েছিল ব্যবসায়ী ইসমাইলফের সঙ্গে। সে বিয়েটা প্রেম বা ওই ধরনের অন্য কোনও কারণে হয়নি– আসলে ইসমাইল তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ওই যা, আর কাতেরিনা গরিবের ঘরের মেয়ে বলে বিশেষ বাছবিচার করার উপায় তার ছিল না।
ইসমাইলফ পরিবার আমাদের শহরে গণ্যমান্যদের ভিতরই। তাদের ব্যবসা ছিল সবচেয়ে সেরা ময়দার, গম পেষার জন্য বড় কল তারা ভাড়া নিয়েছিল, শহরের বাইরে ফলের বাগান থেকে তাদের বেশ দু পয়সা আসত এবং শহরের ভিতরে উত্তম বসতবাড়ি। মোদ্দা কথায়, তারা ধনী ব্যবসায়ীগুষ্ঠির ভিতরেরই একটি পরিবার। তার ওপর পরিবারটিও মোটেই পুষ্যিতে ভর্তি নয়। শ্বশুর তিমোতেইয়েভি ইসমাইল, আশির মতো বয়েস, বহুকাল পূর্বে তার স্ত্রী মারা গেছে। তার ছেলে, কাতেরিনার স্বামী জিনোভিই বরিসিছ, পঞ্চাশের চেয়েও বেশ কিছু বেশি আর সর্বশেষে কাতেরিনা, ব্যস। পাঁচ বছর হল কাতেরিনার বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনও ছেলেপুলে কিছু হয়নি। প্রথম পক্ষের স্ত্রীও কোনও সন্তান রেখে যায়নি– জিনোভিইয়ের সঙ্গে কুড়ি বছর ঘর করার পরও। তার মৃত্যুর পর সে কাতেরিনাকে বিয়ে করে। এবারে সে আশা করেছিল, বুঝি ভগবানের আশীর্বাদ এ-বিয়ের ওপর নেমে আসবে বংশের সুখ্যাতি সম্পত্তি বাঁচাবার জন্য সন্তান হবে, কিন্তু কপাল মন্দ, কাতেরিনার কাছ থেকেও কিছু পেল না।
এই নিয়ে জিনোভিইয়ের মনস্তাপের অন্ত ছিল না, এবং শুধু সে-ই না, বুড়ো বরিসেরও। কাতেরিনারও মনে এই নিয়ে গভীর দুঃখ ছিল। আর কিছু না হোক– এই যে অন্তহীন একঘেয়ে জীবন তাকে মূঢ় মুহ্যমান করে তুলছে তার থেকে সে নিষ্কৃতি পেত, ভগবান জানেন। কতখানি আনন্দ পেত সে, যদি নাওয়ানো খাওয়ানো জামা-কাপড় পরানোর জন্য একটি বাচ্চা থাকত তার নিষ্কৃতি পেত এই বন্ধ, উঁচু পাঁচিলওলা, মারমুখো কুকুরে ভর্তি বাড়িটার অসহ্য একঘেয়েমি থেকে। শুধু তাই নয়, ওই এক খোটা শুনে শুনে তার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল– বিয়ে করতে গেলি কেন, তুই? একটা ভদ্রলোকের জীবন সর্বনাশ করলি তুই মাগী, বাঁজা পাঁঠী। যেন মারাত্মক পাপটা তারই, সে পাপ তার স্বামীর বিরুদ্ধে, শ্বশুরের বিরুদ্ধে, এমনকি তাদের কুল্লে সাধু ব্যবসায়ীগুষ্ঠির বিরুদ্ধে!
ধনৈশ্বর্য, আরাম-আয়েশে পরিপূর্ণ এই বাড়িতে কাতেরিনার ছিল সবচেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন। দেখাটেখা করতে সে যেত খুবই কম এবং যদি-বা তার স্বামীর সঙ্গে তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের বাড়িতে যেত তাতেও কোনও আনন্দ ছিল না। ওরা সব প্রাচীন ধরনের কড়া লোক। তারা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত, সে কীভাবে বসে, তার আচরণ কীরকম, সে কীভাবে আসন ত্যাগ করে; ওদিকে কাতেরিনা তেজি মেয়ে এবং দুঃখদৈন্যে শৈশব কেটেছে বলে সে অনাড়ম্বর ও মুক্ত জীবনে অভ্যস্ত। পারলে সে এখখুনি দুটো বালতি, দু হাতে নিয়ে ছুটে যায় জাহাজঘাটে। সেখানে শুধু শেমিজ গায়ে স্নান করতে। কিংবা বেড়ার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওই ছোঁড়াটার গায়ে বাদামের খোসা ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু হায়, এখানে সবকিছু সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভোর হওয়ার পূর্বেই তার শ্বশুর আর স্বামী ঘুম থেকে উঠে জালা জালা চা খেয়ে ছ-টার ভিতর কাজ কারবারে বেরিয়ে যান, আর সে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ একা একা আলস্যে আলস্যে এ-ঘর ও-ঘর করে করে ঘুরে মরে। সবকিছু ছিমছাম, ফাঁকা। দেব-দেবীদের সামনে স্তিমিত প্রদীপ জ্বলছে। সমস্ত বাড়িতে আর কোনও জনমানবের চিহ্ন নেই, কারও কণ্ঠস্বরের লেশমাত্র নেই।