কাতেরিনা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ভাইপো সোহাগ করে বলল, তুমি বসবে, কাকিমা? আমি তা হলে তোমাকে কাহিনীটা পড়ে শোনাই।
কাতেরিনা উত্তর দিল, একটু দাঁড়াও, আমি এখখুনি আসছি। বসবার ঘরের মঙ্গলপ্রদীপটি ঠিক জ্বলছে কি না দেখে আসি। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল।
পাশের ঘরে যে ফিসফিস করে কথা আরম্ভ হল সেটা অতিশয় নীরবের চেয়েও ক্ষীণ, কিন্তু চতুর্দিকে যে গভীর নৈস্তব্ধ্য বিরাজ করছিল তার ভিতর সেটা ফেদিয়ার তীক্ষ্ণ কর্ণে এসে পৌঁছল।
কান্নার জলভরা কণ্ঠে ছেলেটি চেঁচিয়ে উঠল, কাকিমা, ওখানে কী হচ্ছে? কার সঙ্গে তুমি কথা বলছ? এক মুহূর্ত পরে আরও অশ্রু-ভরা কণ্ঠে আবার চেঁচিয়ে বলল, কাকিমা! এদিকে এসো আমার বড় ভয় করছে। এবার সে যেন কাতেরিনার কণ্ঠে ঠিক আছে শুনতে পেল এবং ভাবল সেটা তারই উদ্দেশে বলা হয়েছে।
দৃঢ় পদক্ষেপে কাতেরিনা এসে এমনভাবে দাঁড়াল যে, তার শরীর ফেদিয়া আর বাইরে যাবার দরজার মাঝখানে। বেশ কড়া গলায় বলল, তুমি খালি খালি কিসের ভয় পাচ্ছ? ঠিক তার পরই বলল, এইবারে তুমি শুয়ে পড়।
আমার যে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না, কাকিমা।
না, না। তুমি এবারে ঘুমোও, ফেদিয়া আমার কথা শোন, শুয়ে পড়… সত্যি, রাত হয়েছে।
কিন্তু কেন এসব, কাকিমা। আমার যে মোটেই শুতে ইচ্ছে করছে না।
না, তুমি শুয়ে পড়, শুয়ে পড়। কাতেরিনার স্বর আবার বদলে গিয়েছে, অল্প অল্প কাঁপছে। তার পর বাহু দু-খানা তুলে ছেলেটাকে দুই কান দিয়ে চেপে ধরে খাটের শিয়রের দিকে শুইয়ে দিল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই ফেদিয়া আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল; সে দেখতে পেয়েছে সেরগেইকে– ফ্যাকাসে মুখ, আর খালি পায়ে সে ঘরে ঢুকছে।
ত্রাসে, ভয়ের বিভীষিকায় ছেলেটা তালু পর্যন্ত মুখ খুলে ফেলেছে। কাতেরিনা সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরল। কড়া গলায় বলল, শিগগির কর, তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসো– চেপে ধরো ছেলেটাকে, ধস্তাধস্তি না করে।
সেরগেই ছেলেটার দু হাত-পা চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা এক ঝটকায় বড় একটা পালকের বালিশ নিয়ে বলির পাঠা সেই ছোট্ট বালকের কচি মুখটি ঢেকে দিয়ে, বালিশের উপর ঝাঁপটে পড়ে তার শক্ত নরম স্তনের উপর চাপ দিতে লাগল।
কবরের ভিতর যে স্তব্ধতা– প্রায় চার মিনিট ধরে সেটা সে ঘরে বিরাজ করল।
অতি মৃদুকণ্ঠে কাতেরিনা বলল, ওর হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু– কিন্তু দাঁড়িয়ে উঠে সবকিছু গোছগাছ করাতে লাগতে না লাগতে, বহু লুকনো পাপের রঙ্গভূমি, নিস্তব্ধ বাড়িটার দেওয়ালগুলো সশব্দ তীব্র মুষ্ট্যাঘাতের পর মুষ্ট্যাঘাতে টলমল করে উঠল; জানালাগুলো খড়খড়িয়ে উঠল, ঘরের মেঝে দুলতে লাগল, মঙ্গলপ্রদীপ ঝোলানোর সরু শিকল দুলে দুলে দেওয়ালের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের উপর অদ্ভুত ছায়াছবির দৌড়াদৌড়ি লাগিয়ে দিল।
সেরগেই আতঙ্কে শিউরে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে লাগাল ছুট। কাতেরিনাও ছুটল তাকে ধরবার জন্য। ওদিকে হট্টগোল তোলপাড় যেন তাদের পিছনে আসছে। যেন কোনও অপার্থিব শক্তি এই পাপালয়কে তার ভিত্তিতল পর্যন্ত ঝাঁকুনি দিয়ে ওলট-পালট করে দিচ্ছে।
কাতেরিনার ভয় হচ্ছিল, পাছে সেরগেই ত্রাসের তাড়নায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে তার আর্ত চেহারা দিয়ে সবকিছু ফাঁস করে দেয়; সে কিন্তু ছুটল সিঁড়ির দিকে উপরের তলায় যাবে বলে।
সেরগেই মাত্র কয়েকটি ধাপ উঠতেই অন্ধকারে একটা আধখোলা দরজার সঙ্গে খেল সরাসরি প্রচণ্ড এক ধাক্কা। আর্তনাদ করে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচের দিকে– কুসংস্কার-ভরা আতঙ্কে সে তখন সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে গিয়েছে।
গড়গড় করে তার গলা দিয়ে শুধু বেরুচ্ছে, জিনোভিই বরিসিছ! জিনোভিই বরিসিছ! আর সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচের দিকে পা উপরের দিকে করে হুড়মুড়িয়ে পড়ার সময় কাতেরিনাকেও ফেলে দিয়ে নিয়ে চলেছে তার সঙ্গে।
কাতেরিনা শুধাল, কোথায়?
সেরগেই আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ওই যে, ওই তো ওইখানে সে একটা লোহার পর্দার উপর বসে বসে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। ওই তো ওই– আবার আসছে সে। শোন, সে গর্জন করছে- গর্জন করছে সে আবার।
এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, অসংখ্য হস্ত রাস্তার দিকে মুখ-করা জানালাগুলোর উপর প্রচণ্ড ঘা দিচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে কে একজন বাড়ির দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে।
কাতেরিনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ওরে হাবা। ওঠ, উঠে পড়, হাবা কোথাকার! কথা ক-টি বলা শেষ করতে না করতে সে তীরের মতো ছুটে গেল ফেদিয়ার কাছে। মরা ছেলেটার মাথা সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বালিশের উপর এমনিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখল যে মনে হয় সে ঘুমুচ্ছে। তার পর শত শত মুষ্টি যে দরজাটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছিল সেইটে দৃঢ়হস্তে খুলে দিল।
সম্মুখে ভীষণ দৃশ্য। দলে দলে লোক রোয়াকের উপর উঠবার চেষ্টা করছে। তাদের মাথার উপর দিয়ে কাতেরিনা দেখতে পেল সারি সারি অপরিচিত লোক উঁচু পাঁচিল টপকে বাড়ির আঙ্গিনায় নামছে– আর বাইরের রাস্তা উত্তেজিত কণ্ঠের কথা-বলাবলিতে গগম্ করছে।
কোনওকিছু ভালো করে বোঝবার পূর্বে রোয়াকের দল কাতেরিনাকে উল্টে ফেলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ঘরের ভিতরে।
.
১২.
এই প্রচণ্ড উত্তেজনা, তুলকালাম কাণ্ড এল কী করে?