ভালো লাগছে?
ভারি চমৎকার, কাকিমা।
ফেদিয়া যখন কথা বলছিল তখন কনুইয়ের উপর ভর করে কাতেরিনা তার দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে দেখছিল। অকস্মাৎ তার অন্তস্তলে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাক্ষসের পাল যেন মুক্ত হয়ে আবার তার সেই পুরনো চিন্তাগুলো সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে ফেলল : এই ছোকরাটা তার কী সর্বনাশই না করেছে, এবং সে অন্তর্ধান করলে তার জীবন কত না আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
কাতেরিনা চিন্তা-সাগরে ডুব দিয়ে ভাবতে লাগল, এখন আর কীই-বা হতে পারে? ছেলেটা এমনিতেই অসুস্থ, তাকে ওষুধ খেতে হচ্ছে .. আর অসুখের সময় কত অঘটনই না ঘটতে পারে। লোকে আর কী বলবে? ডাক্তার ভুল ওষুধ দিয়েছিল!
তোমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে, ফেদিয়া?
হ্যাঁ কাকিমা। তোমার যদি কোনও অসুবিধা না হয়। তার পর চামচে ভরা ওষুধ গিলে বলল, সন্তদের এই জীবনকাহিনী কী অদ্ভুত সুন্দর, কাকিমা।
কাতেরিনা বলল, আরও পড়, বেশ করে পড়। কাতেরিনা তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরটার চতুর্দিকে তাকাতে গিয়ে তার দৃষ্টি নকশা-কাটা ঘষা কাঁচের জানালাগুলোর ওপর গিয়ে পড়ল। তখন বলল, এগুলোর খড়খড়ি বন্ধ করিয়ে নিতে হবে। দাঁড়িয়ে উঠে কাতেরিনা পাশের ঘরে গেল, সেখান থেকে বসবার ঘর হয়ে উপরের তলায় নিজের ঘরে গিয়ে বসল।
পাঁচ মিনিটের ভিতর সরূগেই তার কাছে এল। পরনে ফুলবাবুটির মতো সিলের চামড়ার অস্তরদার পুস্তিনের পোশাক।
কাতেরিনা শুধাল, জানালার খড়খড়িগুলো বন্ধ করা হয়েছে?
কাটখোট্টা সংক্ষেপে সেরগেই হ্যাঁ, বলে, কাঁচি দিয়ে মোমবাতির পোড়া পলতেটুকু কেটে ফেলে স্টোভটার কাছে এসে দাঁড়াল।
সবকিছু চুপচাপ।
কাতেরিনা জিগ্যেস করল, আজ রাত্রে গির্জার উপাসনা অনেকক্ষণ অবধি চলবে না?
সেরগেই উত্তর দিল, কালকের পরবটা বড় রকমের; উপাসনা দীর্ঘ হবে। আবার সবকিছু চুপচাপ।
কাতেরিনা দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আমাকে নিচে ফেদিয়ার কাছে যেতে হবে; সে সেখানে একেবারে একলা।
ভুরু নিচু করে কাতেরিনার দিকে সোজা তাকিয়ে সেরগেই শুধাল, একেবারে একলা?
একেবারে একলা। কাতেরিনা ফিসফিস করে উত্তর দিয়ে শুধাল, কেন? তাতে কী হয়েছে?
দুজনের চোখে চোখে যেন বিদ্যুতে বিদ্যুতে ধারাবহ্নি জ্বলে উঠল; কিন্তু দুজনার ভিতর শব্দমাত্র বিনিময় হল না।
কাতেরিনা নিচের তলায় গিয়ে এ-ঘর ও-ঘর প্রত্যেকটি খালি ঘর ভালো করে তদারক করে নিল। সর্বত্র শান্ত– নিঃশব্দ নৈস্তব্ধ্য। ইকনগুলোর নিচে মঙ্গলপ্রদীপ নিষ্কম্প জ্যোতি বিচ্ছুরিত করছে। কাতেরিনার ছায়া তার সমুখ দিকে যেন দ্রুততর গতিতে এগিয়ে গিয়ে প্রাচীর-গাত্রে প্রসারিত হচ্ছে। খড়খড়ি তুলে দেওয়ার ফলে জানলার উপর জমে-যাওয়া বরফ গলে গিয়ে চোখের জলের মতো ঝরে পড়ছে। বিছানার উপর বালিশে ভর করে বসে ফেদিয়া তখনও পড়ছিল। কাতেরিনাকে দেখে সে শুধু বলল, কাকিমা, এ বইখানা নাও, লক্ষ্মীটি, আর ইকনের তাক থেকে ওই বইখানা দাও তো।
কাতেরিনা তার অনুরোধ পালন করে বইখানা তাকে দিল।
ফেদিয়া, এখন তুমি ঘুমিয়ে পড়লে ভালো হয় না?
না, কাকিমা, আমি দিদিমণির জন্য অপেক্ষা করব।
দিদিমণির জন্য অপেক্ষা করবে কেন?
আমার জন্য অহোরাত্র-উপাসনার নৈবেদ্য আনার কথা দিয়েছে দিদিমণি।
কাতেরিনার মুখ হঠাৎ একদম পাংশু হয়ে গেল। হৃৎপিণ্ডের নিচে সে এই প্রথম তার সন্তানের স্পন্দন অনুভব করল। সমস্ত বুক তার হিম হয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে আপন ঠাণ্ডা হাত দু-খানা গরম করবার জন্য ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেল।
শোবার ঘরে নিঃশব্দে ঢুকে দেখল সেরগেই স্টোভের কছে দাঁড়িয়ে। ফিসফিস করে তাকে বলল, ওইখানে।
প্রায় অস্ফুট কণ্ঠে সেরগেই শুধল, কী? তার গলাতে কী যেন আটকে গেল।
সে একেবারে একলা।
সেরগেই ভুরু কোঁচকাল। তার শাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে।
কাতেরিনা হঠাৎ দোরের দিকে রওনা দিয়ে বলল, চল।
সেরগেই তাড়াতাড়ি জুতো খুলে ফেলে শুধাল, সঙ্গে কী নেব?
কাতেরিনা অতি অস্ফুট কণ্ঠে বলল, কিছু না। তার পর নীরবে সেরগেইয়ের হাত ধরে তাকে পিছনে পিছনে নিয়ে চলল।
.
১১.
এই নিয়ে তিন বারের বার কাতেরিনা যখন অসুস্থ বালকের ঘরে ঢুকল তখন সে হঠাৎ ভয়ে কেঁপে ওঠাতে বইখানা তার কোলে পড়ে গেল।
কী হল, ফেদিয়া?
বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে ফেদিয়া ভীত স্মিত হাস্যে বলল, ও, হঠাৎ যেন কিসের ভয় পেলুম কাকিমা।
কিসের ভয় পেলে?
তোমার সঙ্গে কে ছিল, কাকিমা?
কোথায়? আমার সঙ্গে তো কেউ ছিল না। লক্ষ্মীটি।
কেউ ছিল না?
ফেদিয়া খাটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা হয়ে, তার কাকিমা যে দোর দিয়ে ঢুকেছিল সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন খানিকটা আশ্বস্ত হল!
বলল, বোধহয় আমার নিছক কল্পনাই হবে।
কাতেরিনা খাটের খাড়া তক্তায় কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল। ফেদিয়া তার কাকির দিকে তাকিয়ে বলল, তার মনে হচ্ছে, কেন জানিনে, তাকে বড় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।
উত্তরে কাতেরিনা ইচ্ছে করে কেশে দরজার দিকে তাকিয়ে কী যেন প্রতীক্ষা করল। সেখান থেকে এল– কাঠের মেঝে থেকে সামান্যতম মচমচ শব্দ।
আমার নামে যে কুলগুরুর নাম– তাঁর জীবনকথা আমি পড়ছি, কাকিমা! বীরযোদ্ধা শহিদ হয়ে কীরকম পরমেশ্বরের কাছে প্রিয়রূপে গণ্য হলেন।