আর সেরগেই বার বার একটানা ওই একই রাগিণী কাতেরিনার সম্মুখে গাইতে লাগল; ওই ফেদোর লিয়ামিন ছোঁড়াটার জন্যে তার সর্বনাশ হয়েছে। সে যে আশা করেছিল, একদিন সে বণিকগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে কাতেরিনা ভড়কে বসাবে সে আশা পূরণের সম্ভাবনা থেকে সে বঞ্চিত হল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যে করেই হোক, এ ধরনের আলাপ সেরগেই শেষ পর্যন্ত এই সমাধানেই নিয়ে আসত যে, স্বামীর অন্তর্ধানের ন মাসের ভিতর যদি কাতেরিনা তার পেটের বাচ্চাটিকে প্রসব করে তাবৎ সম্পত্তির অধিকারী হয়, তবে তাদের সুখের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না–কিন্তু মাঝখানে এই ফেদোর ছোঁড়াটা উড়ে এসে জুড়ে বসে তাদের সর্বনাশ করেছে।
১০. মালিকানা স্বত্ব
১০.
অকস্মাৎ সেরগেই ফেদোর লিয়ামি এবং তার মালিকানা স্বত্ব সম্বন্ধে সর্ব আলোচনা বন্ধ করে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে ফেদোরের চিন্তা কাতেরিনার সর্ব হৃদয়-মন যেন গ্রাস করে বসল। দুশ্চিন্তা আশঙ্কা তাকে এমনই মোহাচ্ছন্ন করে তুলল যে, সে যেন তার জাল ছিন্ন করে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না। এমনকি সেরগেইকে আদর-সোহাগ করা পর্যন্ত তার আর রুচছিল না। ঘুমন্ত অবস্থায়ই হোক, কিংবা ঘর-সংসারের কাজ-কর্ম করার সময়েই হোক, অথবা তার ইষ্ট-দেবতাকে স্মরণ করার সময়ই হোক– উদয়াস্ত তার মনে মাত্র একটি চিন্তা : এ যে এক্কেবারে ডাহা অবিচার। বাস্তবিকই এ আবার কী? কোত্থেকে পুঁচকে একটা ছোঁড়া এসে জুটল, আর আমি আমার সর্বস্ব থেকে বঞ্চিত হব? আমি এতখানি যন্ত্রণা সইলুম, পর্বতপ্রমাণ পাপের বোঝা আমার আত্মসত্তার ওপর চাপালুম, আর কোনও হাঙ্গামা-হুজ্জৎ না পুইয়ে, খড়ের কুটোটি পর্যন্ত কুড়িয়ে না তুলে হঠাৎ এই ছোঁড়াটা এসে আমার তাবৎ-সর্বস্ব কেড়ে নেবে?… তা-ও না হয় বুঝতুম, দাবিদার ভারিক্কি বয়েসের কেউ যদি হত– তা নয়, একটা নাবালক কোথাকার,- পুঁচকে ছোঁড়া।
***
বাইরে প্রথম শীতের আমেজ লেগেছে। জিনোভিই বরিসিচের কোনও খবরই কোনওদিক থেকে এল না– আর আসবেই-বা কী করে? কাতেরিনা ক্রমেই মোটা হয়ে উঠেছিল আর সমস্তক্ষণ ভাবনা-ভরা মন নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। ওদিকে শহরের লম্বা রসনা তাকে নিয়ে, তার কী করে এটা হল, তার কী করে সেটা হল তাই নিয়ে সুবোসাম জল্পনা-কল্পনা গুজব-গুল নিয়ে মেতে উঠেছিল : যেমন– এই যে হুঁড়ি কাতেরিনাটা অ্যাদ্দিন ধরে ছিল বাজা পাঠীটা আর দিনকে দিন শুকোতে শুকোতে হয়ে যাচ্ছিল পুঁই ডাটাটির মতন, এখন হঠাৎ তার সামনের দিকটা ওরকমধারা কেঁপে উঠতে লাগল কেন? এবং এদিকে সম্পত্তির ছোকরা মালিক ফেদিয়া লিয়ামিন খরগোশের চামড়ার হালকা কোটটি পরে বাড়ির আঙিনায় খেলাধুলো করে আর ছোট ছোট গর্তে জমে-যাওয়া বরফ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভেঙে ভেঙে দিন কাটাচ্ছিল।
রাঁধুনী আকসিনিয়া আঙিনার উপর দিয়ে তার পিছনে ছুটে যেতে যেতে চিৎকার করে করে ডাকছে, এ কী হচ্ছে ফেদোর ইগনাতিচ? খানদানি সদাগরের ছেলে তুমি, এ কী হচ্ছে সব? গর্তের জলে-কাদায় মাখামাখি করা কি শেঠজির ছেলের সাজে?
কাতেরিনা আর তার বল্লভের সবকিছু ওলোট-পালোট করে সম্পত্তির হিস্যেদারটি নিরীহ ছাগলছানার মতো বাড়িময় তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে, তার চেয়েও নিরীহ অকাতর নিদ্রায় ঘুমোয় মাত্রাধিক স্নেহময়ী দিদিমার পাশে। জাগরণে বা স্বপ্নে কখনও তার মনে এক মুহূর্তের তরেও উদয় হয়নি, সে কারও পাকা ধানে মই দিয়েছে কিংবা কারও সুখে এতটুকু ব্যাঘাত-ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে।
বড় বেশি ছুটোছুটির ফলে অবশেষে ফেদিয়ার জল-বসন্ত হল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুকের ব্যথা। বেচারিকে তখন বাধ্য হয়ে শয্যাগ্রহণ করতে হল। গোড়ার দিকে জড়িমড়ি দিয়ে তার চিকিৎসা করা হল, শেষটায় ডাক্তার ডাকতে হল।
ডাক্তার ভিজিট দিতে শুরু করলেন। তাঁর প্রেসক্রিপশনমতো ওষুধ ফেদিয়াকে প্রতি ঘণ্টায় খাওয়ানো হল– কখনও দিদিমা খাওয়াতেন, কখনও বা তার অনুরোধে কাতেরিনা।
দিদিমা কাতেরিনাকে বলতেন, মা লক্ষ্মী সোনামণি কাতেরিনা আমার! বাচ্চাটিকে একটু দেখ-ভাল্ কর মা আমার। আমি জানি, শরীরের ভারে তোমার নিজেরই বড় বেশি চলাফেরা করতে কষ্ট হচ্ছে, আর মা ষষ্ঠীর কৃপার জন্য তুমিও অপেক্ষা করছ– তবু বাচ্চাটির দিকে একটু নজর রেখ, লক্ষ্মীটি।
কাতেরিনা অসম্মত হয়নি। বুড়ি যখনই গির্জার সন্ধ্যারতিতে যেত, কিংবা অহোরাত্র উপাসনায় রোগশয্যায় যন্ত্রণায় কাতর বাছা ফেদিয়ার জন্য প্রার্থনা করতে অথবা ভোরবেলাকার প্রথম পূজার প্রসাদ ফেদিয়ার জন্য আনতে যেতে হত, কাতেরিনা তখন অসুস্থ বাচ্চাটির পাশে বসত, জল খাওয়াত, সময়মতো ওষুধ খাইয়ে দিত।
এই করে করে তাই যখন শীতের উপবাস আরম্ভের পরব উপলক্ষে বুড়ি সন্ধ্যারতি আর অহোরাত্র উপাসনা করার জন্য গির্জেয় গেল তার যাবার পূর্বে আদরের কাতেরিনাকে অনুরোধ করে গেল সে যেন ফেদিয়ার যত্নআত্তি করে। ততদিনে ছেলেটি অবশ্য আরোগ্যলাভ করে উঠছিল।
কাতেরিনা ফেদিয়ার ঘরে ঢুকে দেখে সে কাঠবিড়ালির চামড়ার তৈরি কোট পরে বিছানায় বসে সন্তদের জীবনকাহিনী পড়ছে।
গদিওলা কুর্সিতে আরাম করে বসে কাতেরিনা শুধলো, কী পড়ছ, ফেদিয়া? আমি সন্তদের জীবনকাহিনী পড়ছি, কাকিমা।*[* আসলে বউদি, কিন্তু রাশানরা আমাদের মতো যৌথ পরিবারে বাস করে না বলে একে অন্যকে সম্বোধনের সময় আমাদের মতো বাছবিচার করে না।]