তারাও তখন অবাক হয়ে ভাবত ব্যাপারটি কী।
এমন সময় মিল থেকে খবর এল, অনেকদিন হল কর্তা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। যে কোচম্যান গাড়িটি চালিয়েছিল সে বলল, জিনোভিইকে কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ বলে মনে হচ্ছিল এবং কেমন যেন বেখাপ্পাভাবেই সে তাকে বিদায় দিয়েছিল; শহরের মঠের কাছে পৌঁছে সে তার কার্পেট-ব্যাগটি হাতে তুলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে চলে যায়। এ কাহিনী শুনে তাদের মনের ধাঁধা আরও যেন বেড়ে গেল।
জিনোভিই বরিসিচ অন্তর্ধান করেছে; ব্যস, এ সম্বন্ধে আর কারও কিছু বলার নেই। তাকে খুঁজে বের করবার জন্য চেষ্টা ও অনুসন্ধান আরম্ভ হল, কিন্তু তার ফলে কিছুই প্রকাশ পেল না; সে যেন হাওয়ার সঙ্গে গলে গিয়ে মিশে গিয়েছে। কোচম্যানটাকে অবশ্য গ্রেফতার করা হয়েছিল; তার কাছ থেকে মাত্র এইটুকু জানা গেল যে, জিনোভিই তাকে মঠের কাছে ছেড়ে দিয়ে একা চলে যায়। সমস্ত ব্যাপারটা মোটেই পরিষ্কার হল না। ওদিকে বিধবা কাতেরিনা সেরগেইয়ের সঙ্গে শান্তভাবে বেপরোয়া জীবনযাপন করতে লাগল। মাঝে মাঝে গুজব রটত, জিনোভিইকে কখনও এখানে দেখা গিয়েছে, কখনও ওখানে দেখা গিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আর বাড়ি ফিরে এল না। কাতেরিনা আর সকলের চেয়ে ভালো করেই জানত, জিনোভিই আর কখনও ফিরে আসবে না, ফিরে আসতে পারে না।
এক মাস গেল, দু মাস গেল, তিন মাস গেল–কাতেরিনা পেটের বাচ্চার ভার বেশ টের পেতে লাগল।
একদিন সে বলল, সেরেজেশকা, এবারে আমাদের ধন-দৌলত নিরাপদ হল। আমি তোমাকে একটি বংশধর দেব। সঙ্গে সঙ্গে শহরের কর্মকর্তাগণের কাছে দরখাস্ত করে জানাল : তার এবং তার বিষয়সম্পত্তি– অমুক, তমুক এবং সে বুঝতে পেরেছে সন্দেহ নেই, সে অন্তঃসত্ত্বা; ইতোমধ্যে ইসমাইল পরিবারের ব্যবসা-কারবার এক কদম এগোচ্ছে না; তাকে যেন তাবৎ লেনদেনের ওপর সর্ব কর্তৃত্ব এবং স্থাবর সম্পত্তির সর্বত্র অবাধ গতিবিধির অধিকার দেওয়া হয়।
এত বড় একটা কারবার সম্পূর্ণ উচ্ছন্ন যাবে–এ তো কল্পনাতীত। কাতেরিনা তার স্বামীর আইনসঙ্গত স্ত্রী, নোটারকমের কিংবা সন্দেহজনক দেনাও নেই; সুতরাং স্পষ্টই বোঝা গেল দরখাস্ত মঞ্জুর হবে। মঞ্জুর হলও।
অতএব কাতেরিনা জীবনযাপন করতে লাগল– মহারানির মতো চলন-বলন হল এবং তার দেখাদেখি অন্য পাঁচজন আটপৌরে সেরেগাকে পোশাকি সেরগেই ফিলিপিচু, কেষ্টাকে শ্রীকৃষ্ণ নামে সম্মানিত করতে লাগল। এমন সময় বলা-নেই-কওয়া-নেই আসমান থেকে বিনামেঘে বজ্রাঘাত। লিভেন শহর থেকে আমাদের মেয়রের কাছে এই মর্মে চিঠি এল যে, বরিস তিমোতেই যে মূলধন নিয়ে কাজ-কারবার করছিল সেটা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব ছিল না : তার অধিকাংশ এসেছিল তার এক নাবালক ভাগ্নের কাছ থেকে তার নাম ফেদোর জাখার লিয়ামিন; এবং আইনত একটা ফয়সালা না করে কারবারটা একা কাতেরিনার হাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না। নোটিশটা এলে পর মেয়র ব্যাপারটা নিয়ে কাতেরিনার সঙ্গে আলোচনা করলেন এবং তার পর এক সপ্তাহ যেতে না যেতে হঠাৎ লিভেন থেকে এসে উপস্থিত হলেন ছোট্টখাটো একটি বৃদ্ধা মহিলা– সঙ্গে একটি ছোট ছেলে।
মহিলাটি বললেন, আমি স্বৰ্গত বরিস তিমোতেইভিচের সম্পর্কে বোন হই আর ইটি আমার ভাইপো ফেদোর লিয়ামিন।
কাতেরিনা তাদের অভ্যর্থনা জানাল।
আঙিনায় দাঁড়িয়ে সেরগেই এদের আগমন এবং নবাগতদের প্রতি কাতেরিনার অভ্যর্থনা জ্ঞাপন দেখে পাদ্রিদের সাদা জোব্বার মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল!
বাড়ির কর্ত্রী কাতেরিনা সেরগেইকে জিগ্যেস করল, এ কী? তোমার কী হয়েছে? সে আঙিনা ছেড়ে অতিথিদের পিছনে পিছনে হলঘর পর্যন্ত এসে তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কিসসু না, কিসসুটি না। হলঘর ছেড়ে সদর দরজার কাছে এসে সেরগেই উত্তর দিয়ে বলল, আমার মনে হচ্ছিল এই লিভে গুষ্ঠি বাজি হারার পড়তা, জেতার নয়। তার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গিয়ে পিছনের সদর দরজা বন্ধ করে দিল।
***
সে রাত্রে সামোভার ঘিরে বসে সেরগেই কাতেরিনাকে শুধল, তা হলে আমরা এখন করি কী? তোমার আমার আমাদের দুজনার– সবকিছু যে ছাইভস্ম হয়ে গেল।
ছাইভস্ম কেন, সেরেজা?
নয় তো কী? এখন তো সবকিছু ভাগাভাগি হয়ে যাবে। আমাদের হিস্যেয় যা পড়বে তা দিয়ে আমরা চালাব কী করে?
কেন, সেরেজা? তোমার কি ভয় হচ্ছে, তুমি যথেষ্ট পাবে না?
আমি নিজের হিস্যের কথা ভাবছিনে। আমার শুধু সন্দেহ হচ্ছে, আমরা কি আর সুখী হতে পারব?
এ দুর্ভাবনা তোমার মনে কেন উদয় হল? আমরা সুখী হতে পারব না কেন?
সেরগেই উত্তর দিল, তার কারণ, তোমার প্রতি আমার যে প্রেম, সে প্রেম চায় তোমাকে সমাজের উচ্চস্থানের মহিলারূপে দেখতে; আগে যেরকম নগণ্য জীবন যাপন করতে, সেরকম নয়। আর এখন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে; আমাদের আমদানি কমে যাওয়ার ফলে এখন আমাদের আরও টানাটানি করে চালাতে হবে।
তাতে করে আমার জীবনে তো কোনও হেরফের হবে না, সেরেজা।
ঠিক সেই কথাই তো হচ্ছে, কাতেরিনা ভনা; তোমার কাছে সবকিছু পছন্দসই বলে মনে হতে পারে, আমার কিন্তু কস্মিনকালেও তা মনে হবে না এবং তার একমাত্র কারণ তোমাকে আমি মাত্রাধিক শ্রদ্ধা করি। তার ওপর দেখ, সমস্তটা ঘটবে যতসব হিংসুটে ছোটলোকদের চোখের সামনে সেসব দেখে আমার বেদনার আর অন্ত থাকবে না। তুমি অবশ্য যা-খুশি তাই করতে পার কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ পরিস্থিতিতে আমি কখনও সুখী হতে পারব না।