পাদ্রি সাহেবকে ডেকে পাঠাও স্তিমিত কণ্ঠে গোঙরে গোঙরে কোনও গতিকে জিনোভিই এ কটি কথা উচ্চারণ করল– তার বুকের উপর সোয়ার সেরগেইয়ের থেকে সে ঘেন্নার সঙ্গে যতখানি পারে তার মাথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমার অন্তিম অনুষ্ঠান করাতে চাই একটি কথা বেরুল আরও ক্ষীণস্বরে।
সে তখন ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছে আর চোখ বাঁকা করে দেখছে, তার চুলের নিচে যেখানটায় গরম রক্ত জমাট বাঁধছে।
তুমি যেরকম আছ, সেই বেশ চলবে। কাতেরিনা ফিসফিস করল, তার পর সেরগেইকে বলল, ব্যস, ওকে নিয়ে আর আমাদের ঝামেলা বাড়াবার প্রয়োজন নেই; উঁটিটা কষে চেপে ধরো।
জিনোভিইয়ের গলা ঘড়ঘড় করে উঠল।
কাতেরিনা উবু হয়ে তার দু হাত দিয়ে সেরগেইয়ের দু হাতে ভর দিয়ে জিনোভিইয়ের টুটি আরও চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা জিনোভিইয়ের বুকের উপর কান পেতে শুনতে লাগল। পাঁচ মিনিট পর উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, ব্যস, তার যা প্রাপ্য সে তাই পেয়েছে।
সেরগেইও উঠে দাঁড়িয়ে গভীর নিশ্বাস নিল। জিনোভিই খতম হয়ে গেছে তার শ্বাসনালী থেলে গিয়েছে, তার কপালের রগ ফেটে গিয়েছে। তার মাথার বাঁ দিকের নিচে রক্তের ছোট একটা থ্যাবড়া কিন্তু এতক্ষণে জমাট রক্ত আর চুলে সেঁটে গিয়েছে বলে জখম থেকে আর রক্ত বইছিল না।
সেরগেই বরিসিচকে মাটির নিচের মদের ভাঁড়ারে বয়ে নিয়ে গেল– এ কুঠুরিটা ঠিক সেই পাথরের ছোট ভাড়ারঘরের নিচে যেখানে মাত্র কিছুদিন পূর্বে স্বর্গীয় বরিস তিমোতেই এই সেরগেইকে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তার পর ফের কাতেরিনাদের শোবার ঘরে ফিরে এল। ইতোমধ্যে কাতেরিনা হাতের আস্তিন আর পরনের স্কার্ট গুটিয়ে নিয়ে সাবান আর ঘরপোছার ন্যাকড়া দিয়ে শোবার ঘরের মেঝের উপরকার জিনোভিইয়ের রক্তের দাগ অতিশয় কষ্ট-সহিষ্ণুতার সঙ্গে সাফ করতে লাগল। সামোভারের বিষ-মাখানো যে জল দিয়ে চা বানিয়ে জিনোভিই তার স্বাধিকার-চেতন, ক্ষুদ্র পুণ্যাত্মাটিকে গরম করে তুলছিল, সে জল তখনও ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। তারই কৃপায় রক্তের দাগ নিশ্চিহ্ন অবলুপ্ত হল।
সামোভারের সঙ্গে কাপ ধোবার যে জাম-বাটি থাকে সেইটে এবং সাবান-মাখানো ন্যাকড়া তুলে নিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে কাতেরিনা সেরগেইকে বলল, এসো, আমাকে আলো দেখাবে। দরজার কাছে এসে বলে, আলো নিচু করে ধরো- টুকরো টুকরো তক্তা জোড়া দিয়ে যে মেঝে এবং সিঁড়ির উপর দিয়ে সেরগেই জিনোভিইয়ের মৃতদেহ টেনে টেনে মাটির নিচের মদের ভাড়ার পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল, কাতেরিনা সেই তক্তার প্রত্যেকটি গভীর মনোযোগর সঙ্গে পরীক্ষা করল।
রঙ করা তক্তাগুলোর উপরে মাত্র দুটি জায়গায় রক্তের দাগ পাওয়া গেল– আকারে কালোজামের চেয়েও বড় নয়। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে কাতেরিনা সেগুলো ঘষা মাত্রই দাগগুলো লোপ পেল।
এইবারে ঠিক হয়েছে যেমন কর্ম তেমন ফল– আপন বউয়ের পিছনে ওরকম গুপ্তচরের মতো তক্কে তক্কে লেগে থেক না– তার ঘাড়ে লাফ দেবার জন্য ওঁৎ পেতে থেক না। কাতেরিনা বলতে বলতে শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে শানবাঁধানো যে ছোট্ট কুঠুরিতে সেরগেই বন্দি ছিল সে দিকে তাকাল।
সেরগেই বলল, সবকিছু খতম হল–নিজের গলা শুনে সে শিউরে উঠল।
শোবার ঘরে যখন তারা ফিরে এল তখন সরু গোলাপি রেখার মতো পূর্বাকাশ ছিন্ন করে ঊষার উদয় হচ্ছে– ফুলে ঢাকা আপেলগাছের উপর দিয়ে আলতোভাবে ঢলে পড়ে, দেয়ালের উঁচু বেড়ার রেলিঙের ভিতর দিয়ে কাতেরিনার শোবার ঘরে উষা উঁকি মারলেন।
ঘরের বাইরে উঠোনের উপর দিয়ে যাচ্ছে বুড়ো কেরানি কাঁধের উপর ভেড়ার লোমের কোটটা চড়িয়ে, হাই তুলতে তুলতে, আর ডান হাতের তিন আঙুল দিয়ে গাঁয়ের উপর ক্রুশের প্রতীক আঁকতে আঁকতে বুড়ো চলেছে রান্নাঘরের দিকে।
কাতেরিনা সাবধানে খড়খড়ির ফিতে টেনে সেটাকে বন্ধ করে দিয়ে সেরগেইকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল, যেন সে তার অন্তরের আত্মসত্তাটি পর্যন্ত দেখে নিয়ে সেই সত্তাটিকে চিনতে চায়।
সেরগেইয়ের কাঁধের উপর তার শ্বেতশুভ্র হাত দুখানা রেখে বলল, কী গো, এইবারে তুমি তো সদাগরদের একজন হতে চললে।
উত্তরে সেরগেই একটি শব্দমাত্র করল না।
তার ঠোঁট দুটি স্কুরিত হচ্ছিল; কোন যেন এক পীড়া তার দেহে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আর কাতেরিনার কিছুই হয়নি, শুধু তার ঠোঁট দুটিতে যেন শীত-শীত করছিল।
লোহার ডাণ্ডা আর ভারী শাবল ব্যবহার করার ফলে দু-একদিনের ভিতরই সেরগেইয়ের হাতে মোটা মোটা ফোস্কা দেখা দিল। তাতে কী এসে-যায়– জিনোভিই বরিসিচুকে এমনই পরিপাটিরূপে তারই মাটির তলার কুঠুরিতে পুঁতে ফেলা হল যে, তার বিধবা কিংবা বিধবার প্রেমিকের সাহায্য ছাড়া শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।
.
০৯.
সেরগেই লাল একখানা স্কার্ফ জড়িয়ে চলাফেরা করে। ইতোমধ্যে সেরগেইয়ের গলায় বরিস যে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল তার দাগ শুকোবার পূর্বেই কাতেরিনার স্বামীর অনুপস্থিতি আশঙ্কাভরা জল্পনা-কল্পনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। বরিস সম্বন্ধে আর সকলের চেয়ে বেশি কথা বলত সেরগেই নিজে। বিকেলের দিকে কোনও কোনও দিন ছোকরাদের সঙ্গে বেঞ্চিতে বসে সে বলে উঠত, সত্যি, বল তো, ভায়ারা, আমাদের কর্তা এখনও ফিরে এলেন না যে?