আসলে জিনোভিই বরিসিচের মাথা তখন ঘুলিয়ে গিয়েছে। সে প্রথমটায় সেরগেইয়ের দিকে তাকাল– সে তখন দোরের খুঁটিটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পর তাকাল তার স্ত্রীর দিকে সে ততক্ষণে খাটের বাজুতে বসে বুকের উপর এক হাত দিয়ে আরেক হাতের কনুই ধরে আছে; সমস্ত ব্যাপারটা যে কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে সে সম্বন্ধে জিনোভিই কোনও অনুমানই করতে পারছিল না।
এখানে তুই কী করছিস রে বিচ্ছ? চেয়ার থেকে না উঠেই কোনও গতিকে সে বলল।
বেহায়ার মতো কাতেরিনাই উত্তর দিল, তুমি যা-সব খুব ভালো করে জানো সেগুলো সম্বন্ধে আমাদের জিগ্যেস কর না? তুমি ভেবেছিলে আমাকে ঠ্যাঙাবার ভয় দেখাবে– কাতেরিনা বলে যেতে লাগল; তার চোখে কুমতলব মিটমিট করছে, কিন্তু সেটা আর কখনই হয়ে উঠবে না। আর আমি? আমার যা করার সে আমি তোমার ওই প্রতিজ্ঞাগুলো শোনার পূর্বেই স্থির করে রেখেছি, আর এখন সেগুলো তোমার ওপর খাটাব।
জিনোভিই সেরগেইয়ের দিকে চেঁচিয়ে উঠল, কী করছিস এখানে? বেরো!
কাতেরিনা তাকে চোপা দিয়ে বলল, বেশ, বেশ, তার পর?
ঝটপট দোরটা নিখুঁতভাবে বন্ধ করে চাবিটা সে পকেটে রাখল, তার পর ঢিলে। ব্লাউজসর্বদা বিছানায় ফের গড়াগড়ি দিতে লাগল।
কেরানিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, এখানে তবে এসো সেরেজেচকা এসো, এখানে এসো, আমার প্রাণের দুলাল।
সেরগেই মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বাবরি চুল পিছনে ফেরাল; তার পর সাহসীর মতো বাড়ির কত্রীর পাশে এসে বসল।
হে ভগবান, হে প্রভু! এসব কী হচ্ছে? তোরা কী করছিস- ওরে কাফেরের বাচ্চা জিনোভিইয়ের মুখ বেগুনি হয়ে গিয়েছে, আরাম-কেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
বটে? তোমার পছন্দ হচ্ছে না? একবার তাকিয়ে দেখ না, ভালো করে তাকিয়ে দেখ আমার বাজপাখিটির চোখ কীরকম জ্বলজ্বল করে, দেখ না, কী সুন্দরই না সে!
কাতেরিনা অট্টহাস্য করে উঠল এবং স্বামীর সামনে সেরগেইকে আবেগভরে চুম্বন দিতে লাগল।
সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে তার গালে একটা চড় পড়ে যেন সেখানে আগুন ধরিয়ে দিল আর জিনোভিই লাফ দিয়ে ধাওয়া করল ব্যালকনির খোলা জানালার দিকে।
.
০৮.
আহহা! তা হলে এই ব্যবস্থাই হল! বেশ বন্ধু! তোমাকে আমার অনেক ধন্যবাদ জানাই! শুধু এইটের জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলুম উঁচু গলায় বলে উঠল কাতেরিনা, বেশ, বেশ, তা হলে পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আমারই মর্জি-মাফিক সবকিছু হবে, তোমার মর্জি আর চলবে না।
এক ধাক্কায় সেরগেইকে পাশ থেকে ঠেলে দিয়ে, বিদ্যুৎবেগে সে লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল তার স্বামীর ঘাড়ে; জিনোভিইও লাফ দিয়েছিল ব্যালকনির জানালার দিকে কিন্তু তার পূর্বেই কাতেরিনা তার সরু আঙুল জিনোভিইয়ের গলায় প্রায় ঢুকিয়ে দিয়ে চেপে ধরে তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে মেঝের উপর একগুচ্ছ কাটা তাজা শন মানুষ যেরকম অবহেলে ফেলে।
শরীরের সমস্ত ওজন নিয়ে বেগে পড়ার ফলে তার মাথা সজোরে ঠোক্কর খেল মেঝের উপর– আর মাথা গেল ঘুলিয়ে। সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি তার চরমে পৌঁছে গিয়ে স্বপ্রকাশ হতে পারে তার সম্ভাবনা সে মোটেই আন্দাজ করতে পারেনি। তার ওপর তার স্ত্রীর জীবনে এই প্রথম প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে সে বুঝে গেল যে, তার হাত থেকে ছাড়ান পাওয়ার জন্য হেন কর্ম নেই যে তার স্ত্রী করবে না, এবং তার বর্তমান অবস্থা সাতিশয় সঙ্কটময়। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে এই সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করে ফেলছিল বলে সে আর আর্তনাদ করে ওঠেনি– ভালো করেই সে বুঝে গিয়েছিল যে তার আর্তনাদ কারও কানে পৌঁছবে না, বরঞ্চ তাতে করে তার পরিণাম আরও দ্রুতগতিতে পৌঁছে যাবে। নীরবে সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অবশেষে তার দৃষ্টি স্ত্রীর ওপর ফেলল। সে দৃষ্টিতে ছিল জিঘাংসা, অভিসম্পাত আর তীব্রতম যন্ত্রণা। ওদিকে তার স্ত্রী সজোরে তার গলা যেন নিংড়ে ফেলছিল।
জিনোভিই আত্মরক্ষার চেষ্টা করল না। তার মুষ্টিবদ্ধ প্রসারিত দুই বাহু আচমকা আচমকা খিচুনি দিয়ে উঠছিল। তার এক বাহু তখনও সম্পূর্ণ মুক্ত; অন্য বাহু কাতেরিনা তার হাঁটু দিয়ে মাটির সঙ্গে জোরে চেপে ধরেছে।
ধরো জোরসে ওকে। বিন্দুমাত্র উত্তেজনার রেশ না দেখিয়ে সে সেরগেইকে ফিসফিস করে আদেশ দিল। তার পর ফের স্বামীর দিকে মনোনিবেশ করল।
সেরগেই তার মুনিবের উপর বসে তার দুটি হাঁটু দিয়ে মুনিবের দুই বাহু চেপে ধরল। তার পর যেই সে কাতেরিনার হাতের নিচে জিনোভিইয়ের টুটি চেপে ধরতে গেছে অমনি সে নিজেই আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। যে লোকটা তার এমন অন্যায় সর্বনাশ করেছে, তার ওপর চোখ পড়তে, রক্ত দিয়ে রক্তের প্রতিশোধ নেবার দুর্বার কামনা জিনোভিইয়ের অবশিষ্ট সর্বশক্তি উত্তেজিত করে দিল। ভয়াবহ বিক্রম প্রয়োগ করে সে সেরগেইয়ের হাঁটুর চাপ থেকে দুই হাত মুক্ত করে সেরগেইয়ের মিশকালো বাবরি বজ্রমুষ্টিতে ধরে নিয়ে তার গলায় কামড় মেরে বসিয়ে দিল– হুবহু হিংস্র পশুর মতো তার দাঁত। কিন্তু এ আক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিনোভিই গোঁ গোঁ করে কাতরাতে আরম্ভ করল; মাথা একপাশে হেলে পড়ল।
নিশ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে, বিবর্ণ কাতেরিনা তার স্বামী ও প্রেমিকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে; তার ডান হাতে ছাঁচে ঢালাই ভারী একটা মোমবাতিদান– তার ভারী দিকটা নিচের দিকে ঝুলছে। জিনোভিইয়ের রগ আর গাল বেয়ে একটি অতি সূক্ষ্ম সুতোর মতো বয়ে নামছিল চুনি রঙের লাল রক্ত।