জিনোভিই বিষণ্ণ মুখে ঘরের ভিতর পাইচারি করতে লাগল।
তার পর স্ত্রীকে আবার শুধাল, আর এখানে তুমি সময় কাটালে কী করে?
এখানে আমাদের আমোদ-আহ্লাদ কী, সে তো সবাই জানে আমি আর কী বলব; আমরা বল নাচে যাইনে, থিয়েটারও দেখিনে।
আমার তো মনে হল তোমার স্বামীকে দেখে তুমি বিশেষ কোনও আমোদ-আহ্লাদ অনুভব করনি– আমোদ-আহ্লাদ কথাটাই যদি উঠল। আড় নয়নে তাকিয়ে জিনোভিই বলল। এইবারে সে অবতরণিকায় পা দিয়েছে।
তোমাতে-আমাতে তো পরশুদিন বিয়ে হয়নি যে দেখা হওয়ামাত্রই প্রেমে পাগল হয়ে একে অন্যের দিকে ধাওয়া করব। বাড়ির কাজকর্মে ছুটোছুটি করতে করতে আমার পা দু খানি ক্ষয়ে গেল– আর সেসব তোমারই সুখের জন্য। কী করে যে আশা কর তোমাকে দেখামাত্র আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাব?
কাতেরিনা সামোভার আনবার জন্য ছুটে বেরিয়ে গেল আর ধাওয়া করল সেরগেইয়ের দিকে। জামায় টান দিয়ে বলল, হাই তোলা বন্ধ কর! চোখদুটো খোলা রাখ সেরেজা!
শ্রাদ্ধের জল যে কোন দিকে কতখানি গড়াবে সে সম্বন্ধে সেরগেই কোনও স্পষ্ট ধারণা করতে পারেনি, তাই সজাগ হয়ে রইল সে।
কাতেরিনা ফিরে এল। দেখে, জিনোভিই খাটের উপর হাঁটু গেড়ে পুঁতির কেসসুদ্ধ তার ভ্রমণের ঘড়িটা শিয়রের খাড়া তক্তার সঙ্গে ঝোলাচ্ছে।
হঠাৎ সে তার স্ত্রীকে জিগ্যেস করল– কেমন যেন একটু বাঁকা-বাঁকা ভাবে, আচ্ছা, বল তো কাতেরিনা, তুমি তো ছিলে এক্কেবারে একা; তবে ওটা কী করে হল যে, তুমি জোড়া বিছানা সাজিয়ে রেখেছ?
শান্তনয়নে তার দিকে তাকিয়ে কাতেরিনা বলল, কেন, আমি তো সর্বক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলুম।
কৃতজ্ঞতার ধন্যবাদ জানাচ্ছি তার জন্য। আচ্ছা, এইবার দেখ, একটা জিনিস; এটা তোমার পালকের বিছানায় প্রবেশপথ পেল কী করে? জিনোভিই বরিসিচু বিছানার চাদরের উপর থেকে উলে বোনা সরু একটি বেল্ট তুলে নিয়ে এক প্রান্ত উপরের দিকে ধরে তার স্ত্রীর চোখের সামনে দোলাতে লাগল। আসলে এটা সেরগেইয়ের।
কাতেরিনা সামান্যতম দ্বিধা না করে বলল, আমি ওটা বাগানে কুড়িয়ে পেয়ে আমার স্কার্ট বাঁধার জন্য কাজে লাগিয়েছি।
বটে! কথাগুলোয় বদখদ জোর দিয়ে জিনোভিই বলল, তোমার ওই যে স্কার্ট, সে সম্বন্ধে আমরাও আরও দু একটা কথা জানতে পেরেছি।
ঠিক কী শুনতে পেয়েছ?
ও! তোমার সব পুণ্যকর্ম!
সেরকম কিছু হয়নি!
আচ্ছা, আচ্ছা; পরে সেসব দেখা যাবে, পরে সবকিছু দেখা যাবে, খালি পেয়ালাটা ঠেলা মেরে তার স্ত্রীর সামনে ফেলে দিয়ে জিনোভিই উত্তর দিল।
কাতেরিনা একথার উত্তরে কোনও সাড়া দিল না।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিনোভিই ভুরু কপালে তুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার তাবৎ কীর্তিকলাপ আমরা প্রশস্ত দিবালোকে টেনে বের করব, বুঝলে কাতেরিনা ভভূনা?
কাতেরিনা উত্তর দিল, ভয়ে যারা ইঁদুরের গর্ত খোঁজে তোমার কাতেরিনা সে দলের নয়। সে অত সহজে ভয় পায় না।
কী বললে? কী বললে? জিনোভিই গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
যাগগে ও-সব… আমি আমার ফেরির পসরা দু-বার হকিনে। স্ত্রী উত্তর দিল!
বটে! সাবধান! একটু সাবধান হও দিকিনি–বড্ড বেশি বকর বকর করতে শিখে গেছ তুমি, যবে থেকে একলা-একলি থাকছ– কী জানি কী করে?
কাতেরিনা চোপা দিয়ে বলল, বকর বকর করতে আমার যদি প্রাণ চায় তবে তার বিরুদ্ধে কোনও মহামূল্যবান কারণ আছে কি?
দেখ, এখনও নিজের ওপর নজর রাখ।
আমার নিজের ওপর নজর রাখবার মতো কিছুই নেই। কোথাকার কে লম্বা জিভ নাড়িয়ে তোমাকে যা-তা শুনিয়েছে, আর আমাকে বসে বসে হরেক রকমের গালি-গালাজ শুনতে হবে নাকি? এ আবার কী এক নতুন তামাশা আরম্ভ হল!
লম্বা জিভ হোক আর নাই হোক, তোমার ঢলাঢলির কেচ্ছা এখানে বিস্তর লোকই জেনে গিয়েছে।
কাতেরিনা এবারে সত্যি সত্যি ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কী ঢলাঢলি আমার?
আমি জানি কোনটা।
তাই নাকি? যদি জানোই তবে চালাও : সাফ সাফ খুলে বল।
জিনোভিই কোনও উত্তর না দিয়ে খালি পেয়ালাটা আবার ঠেলা মেরে তার স্ত্রীর সামনে ফেলল।
স্বামীকে যেন খোঁচা দেবার জন্যে একটা চামচ তার স্বামীর পিরিচে খটাং করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘেন্নার সুরে বলল, আসলে পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তেমন কিছু বলবার মতো নেই। না হলে বল না, বল, বল আমাকে, কার সম্বন্ধে তারা তোমাকে বলেছে? কে সে আমার প্রেমিক যাকে আমি তোমার চেয়ে বেশি পছন্দ করি?
জানতে পাবে– অত তাড়া কিসের?
বল না! তবে কি কেউ কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে সেরগেইয়ের সম্বন্ধে মিথ্যে মিথ্যে লাগিয়েছে। তাই কি না?
আমরা সব বের করব, আমরা সব বের করব, বাহারে বিবি কাতেরিনা ভভূনা। তোমার ওপর আমাদের যে অধিকার সেটা কেউ কেড়ে নেয়নি, কেউ নিতে পারবেও না… তুমি শায়েস্তা হয়ে নিজের থেকেই নিজের সম্বন্ধে সবকিছু বলবে—
আখ! আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে! দাঁত কিড়িমিড়ি খেয়ে কাতেরিনা চিষ্কার করে উঠল– রাগে তার মুখের রঙ সাদা বিছানার চাদরের মতো হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সে লাফ দিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
কয়েক সেকেন্ড পরে সেরগেইয়ের আস্তিন ধরে ঘরের ভিতর তাকে টেনে এনে কাতেরিনা বলল, এই তো, এখানে সে। ওকে আর আমাকে জিগ্যেস কর, যখন এতসব তোমার জানাই আছে। হয়তো যতখানি জেনে তৃপ্ত হও তার চেয়েও বেশি জানতে পাবে।