সেরগেই জেগে উঠল, কাতেরিনাকে শান্ত করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু নিদ্রাদেবী কাতেরিনাকে ত্যাগ করে চলে গেছেন– ভাললাই, এক হিসেবে ভালোই।
বিস্ফারিত নয়নে কাতেরিনা শুয়ে আছে, হঠাৎ তার কানে এল কে যেন গেট বেয়ে উঠে বাড়ির ভিতরের আঙিনার সামনে পৌঁছে গেছে। সে তোক যেই হোক, কুকুরগুলো তার দিকে ধাওয়া করেছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তারা শান্ত হয়ে গেল হয়তো-বা তারা নবাগতের পা চাটতে আরম্ভ করেছে। তার পর আরও এক মিনিট গেল। ক্লিক করে নিচের লোহার খিল খুলে গেল এবং দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল।
হয় আমি শব্দগুলো কল্পনায় শুনছি, অথবা আমার জিনোভিই বরিসি ফিরে এসেছেন– এবং দরজা খুলেছেন ফালতো চাবিটি দিয়ে–চট করে চিন্তাটা কাতেরিনার মাথায় খেলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে সেরগেইকে কনুই দিয়ে গুতো দিল।
কান পেতে শোন, সেরেজা, বলে কাতেরিনা কনুইয়ের উপর ভর করে উঠে কানদুটো খাড়া করল।
সত্যই কে যেন ধীর পদক্ষেপে, সাবধানে শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে সরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরের চাবিরা শোবার ঘরের দিকে আসছে।
সুদ্ধমাত্র শেমিজ পরা অবস্থাতেই এক লাফ দিয়ে কাতেরিনা খাট ছেড়ে ব্যালকনির জানালা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সেরগেইও খালি পায়ে লাফ দিয়ে ব্যালকনিতে এসে নামবার জন্য তারই খুঁটিতে পা দিয়ে জড়িয়ে ধরল– ওই খুঁটি বেয়েই সে একাধিকবার তার প্রভুপত্নীর শোবার ঘর থেকে নিচে নেমেছে।
কাতেরিনা তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, না, না; দরকার নেই, দরকার নেই। তুমি এইখানে শুয়ে থাকো… এখান থেকে নোড় না। তার পর সেরগেইয়ের জুতো, কোট-পাতলুন তার পিছনে ছুঁড়ে দিয়ে লাফ মেরে কম্বলের তলায় ঢুকে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
সেরগেই কাতেরিনার আদেশ পালন করল; খুঁটি বেয়ে নিচে না নেমে ছোট্ট ব্যালকনিটির কাঠের ছাতার নিচে আরাম করে লুকিয়ে রইল।
ইতোমধ্যে কাতেরিনা শুনতে পেয়েছে, তার স্বামী কীভাবে দরজার কাছে এল, এবং দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল। এমনকি সে তার হিংসাভরা বুকের দ্রুত স্পন্দন পর্যন্ত শুনতে পেল। কিন্তু কাতেরিনার হৃদয়ে করুণার উদয় হল না। বরঞ্চ তাকে যেন ছেয়ে ফেলল পিশাচের অট্টহাস্য।
মনে মনে সে তার স্বামীকে উদ্দেশ করে বলল, যাও, গতকাল খোঁজ গে– মৃদু হেসে সে যতদূর সম্ভব তালে তালে নিষ্পাপ শিশুটির মতো দম ফেলতে লাগল।
প্রায় দশ মিনিট ধরে এই লীলা চলল; অবশেষে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর ঘুমনোর শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করাটা জিনোভিইয়ের কাছে ক্লান্তিজনক হয়ে দাঁড়াল। সে তখন দরজায় টোকা দিল।
কে? কাতেরিনা সাড়া দিল কিন্তু একদম সঙ্গে সঙ্গে না, এবং গলাটা যেন নিদ্রায় জড়ানো।
জিনোভিই উত্তর দিল, তোমাদেরই একজন।
তুমি নাকি, জিনোভিই বরিসি?
হ্যাঁ, আমি যেন আমার গলা শুনতে পারছ না।
কাতেরিনা সেই যে শুধু শেমিজ পরে শুয়েছিল সেইভাবেই লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে দিল, তার পর ফের লাফ দিয়ে গরম বিছানায় ঢুকল।
কম্বল দিয়ে গা জড়াতে জড়াতে বলল, ঠিক ভোরের আগে কেমন যেন শীতটা জমে আসে।
জিনোভিই বরিসি ঘরে ঢুকে চতুর্দিকে তাকাল, তার পর ইকনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করল, মোমবাতি জ্বালিয়ে আবার চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখল। স্ত্রীকে শুধালো, কীরকম আছ– সব ঠিক চলছে?
কাতেরিনা উত্তর দিল, নালিশ করার মতো তেমন কিছু নয়। তার পর উঠে বসে একটা ঢিলে সুতির ব্লাউজ পরতে লাগল।
শুধল, তোমার জন্য একটা সামোভারে আঁচ দেব কি?
তোমার কিছু করতে হবে না; আকসিনিয়াকে ডাক– সে তৈরি করুক।
কাতেরিনা চটি পরে ছুটে বেরোল এবং ফিরল আধঘণ্টাটাক পরে। এরই ভিতরে সে ছোট্ট সামোভারটিতে কাঠ-কয়লার আগুন ধরিয়ে নিয়েছে এবং অতিশয় সন্তর্পণে বিদ্যুৎবেগে একবার ছুটে গেছে ছোট্ট ব্যালকনিটির নিচে সেরগেইয়ের কাছে।
এইখানে থাক–ফিসফিস করে কাতেরিনা সেরগেইকে বলল।
সেরগেইও ফিসফিস করে প্রশ্ন শুধাল, এখানে বসে থেকে কী লাভ হবে?
ওহ্! তোমার মাথায় কি রত্তিভর মগজ নেই! আমি যতক্ষণ না অন্য ব্যবস্থা করি, তুমি এইখানে থাক।
কাতেরিনা স্বয়ং তাকে আগের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে চলে গেল।
সেরগেই বাইরের ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে ভিতরে যা-কিছু হচ্ছিল সবই শুনতে পারছিল। কাতেরিনা যে দরজা বন্ধ করে স্বামীর কাছে ফিরে এল সেটাও শুনতে পেল। ঘরের ভিতরকার টু শব্দটিও পরিষ্কার তার কানে আসছিল।
জিনোভিই স্ত্রীকে জিগ্যেস করল, এতক্ষণ ধরে কোথায় আলসেমি করে সময় কাটালে?
শান্তকণ্ঠে উত্তর দিল, আমি সামোভার তৈরি করছিলুম।
কিছুক্ষণ ধরে আর কোনও কথাবার্তা হল না। বাইরের থেকে সেরগেই পরিষ্কার শুনতে পেল, জিনোভিই তার লম্বা কোটটা হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল। তার পর সে চতুর্দিকে জল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, জোরসে নাক সাফ করে হাতমুখ ধুলো। এইবারে সে একখানা ভোয়ালে চাইল– সেটাও শোনা গেল। আবার কথাবার্তা শুরু হয়েছে।
স্বামী শুধাল, আচ্ছা, বল তো তোমরা ঠিক কীভাবে আমার বাপকে গোর দিলে?
ঠিক যেভাবে হয়ে থাকে–উত্তর দিল তার স্ত্রী। তিনি মারা গেলেন, সবাই মিলে তাকে গোর দিল।
কিন্তু সক্কলের কাছেই এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ঠেকেছে!
ভগবান জানেন শুধু।- কাতেরিনা উত্তর দিয়ে ঠুং-ঠাং করে পেয়ালাগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল।