For men must work
And women must weep
অর্থাৎ কোনো তর্ক নেই, যুক্তি নেই, ন্যায় অন্যায় নেই, মেয়েদের কর্ম হচ্ছে পুরুষের আকাট মূর্খতার জন্য চোখের জল ফেলে খেসারতি দেওয়া। কিন্তু আশ্চর্য, এ-বেদনাটা প্রকাশও করে আসছে পুরুষই, কবিরূপে। শুনেছি পাঁচ হাজার বৎসরের পুরোনো বাবিলনের প্রস্তরগাত্রে কবিতা পাওয়া গিয়েছে কবি মা-জননীদের চোখের জলের উল্লেখ করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
ইস্কুলের পরেই একখানা ছোটো বসতবাড়ি। আমান উল্লার বোনের বিয়ের সময় লক্ষ্ণৌ থেকে যেসব গানেওয়ালী নাচনেওয়ালীদের আনানো হয়েছিল তারা উঠেছিল এই বাড়িতে। তাদের তত্ত্বতাবাশ করার জন্য আমরা কয়েকজন ভারতীয় তাদের কাছে গিয়েছিলুম। আমাদের সঙ্গে কথা কইতে পেয়ে সেই অনাত্মীয় নির্বাসনে তারা কী খুণীটাই না হয়েছিল। জানত, কাবুলে পান পাওয়া যায় না—আর পান না হলে মজলিস জমবে কি করে, ঠুংরি হয়ে যাবে ভজন–তাই তারা সঙ্গে এনেছিল বাবোঝাই পান। আমাদের সেই পান দিয়েছিল অকৃপণ হস্তে, দরাজ-দিলে। লক্ষ্ণৌয়ের পান, কাশীর জর্দা, সেদ্ধ-ছকা খয়ের তিনে মিলে আমার মুখের জড়তা এমনি কেটে দিয়েছিল যে, আমি তখন উর্দু ছেড়েছিলুম একদম লওয়ী কায়দায় বিস্তর মেহেরবানী, গরীব-পরওরী, বন্দা-নওয়াজীর প্রপঞ্চ-ফোড়ন দিয়ে।
কাবুলের নিজস্ব উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নেই। ইরানের ঐতিহ্যও কাবুল স্বীকার করে না। কাবুলে যে দেড় জন কলাবত আছেন তারা গান শিখেছেন যুক্তপ্রদেশে। বাঈজীদের মজলিসে তাই সম দেনেওয়ালার অভাব হতে পারে এই ভয়ে গানের মজলিসে উপস্থিত থাকার জন্য ভারতীয়দের সাড়ম্বর নিমন্ত্রণ ও সনির্বন্ধ অনুরোধ করা হয়েছিল। আমরা সামনে বসে বিস্তর মাথা নেড়েছিলুম আর ঘন ঘন শাবাশ, শাবাশ চিৎকারে মজলিস গরম করে তুলেছিলুম।
বাড়ি ফিরে আহারাদির পর যখন শেষ পানটা পকেট থেকে বের করে খেয়ে জানলা দিয়ে পিক ফেললুম তখন আবদুর রহমান ভয়ে ভিরমি যায় আর কি। কাবুলে পানের পিক অজানা কিন্তু যক্ষ্মা অজানা বস্তু নয়।
তারপরই শিক্ষামন্ত্রীর দফতর। একসেলেন্সি ফয়েজ মুহম্মদ খানকে দোস্ত মুহম্মদ দুচোখে দেখতে পারতেন না। আমার কিন্তু মন্দ লাগত না। অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং বড়ই নিরীহ প্রকৃতির লোক। আর পাঁচজনের তুলনায় তিনি লেখাপড়া কিছু কম জানতেন না, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী হতে হলে যতটা দরকার ততটা হয়ত তার ঠিক ছিল না। বাচ্চা রাজা হয়ে আর তাবৎ মন্ত্রীদের উপর অত্যাচার চালিয়ে তাঁদের কাছ থেকে গুপ্তধন বের করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীকে নাকি, তুই যা, তুই তো কখনো ঘুস খাসনি বলে নিষ্কৃতি দিয়েছিল। অথচ শিক্ষা বিভাগে টু পাইস কামাবার যে উপায় ছিল না তা নয়। কাবুলে নাকি ঢেউ গোনর কাজ পেলেও অবশ্য সে-কাজ সরকারি হওয়া চাই— দুপয়সা মারা যায়।
লোকটিকে আমার ভালো লাগত নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে। এই বেলা সেটা বলে ফেলি, হাওয়াই-জাহাজ কারো জন্য দাঁড়ায় না, উড়তে পাড়লেই বাঁচে।
চাকরীতে উন্নতি করে মানুষ হয় বুদ্ধির জোরে, নয় ভগবানের কৃপায়। বুদ্ধিমানকে ভগবানও যদি সাহায্য করেন তবে বোকাদের আর পৃথিবীতে বাঁচতে হত না। আমার প্রতি ভগবান সদয়। ছিলেন বলেই বোধ করি শিক্ষামন্ত্রী প্রথম দিন থেকেই আমার দিকে নেকনজরে তাকিয়েছিলেন। তারপর এক বৎসর যেতে না যেতে অহেতুক একধাক্কায় মাইনে এক শ টাকা বাড়িয়ে সব ভারতীয় শিক্ষকদের উপরে চড়িয়ে দিলেন।
পাঞ্জাবী শিক্ষকেরা অসন্তুষ্ট হয়ে তার কাছে ডেপুটেশন নিয়ে গিয়ে বললেন, সৈয়দ মুজতবা আলীর ডিগ্রী বিশ্বভারতীর, এবং বিশ্বভারতী রেকগনাইজড, য়ুনিভার্সিটি নয়।
খাঁটী কথা। সদাশয় ভারতীয় সরকারের নেকনজরে আমার ডিগ্রী এখনো ব্রাত্য। আপনারা কেউ আমাকে চাকরী দিলে বিপদগ্রস্ত হবেন।
শিক্ষামন্ত্রী নাকি বলেছিলেন–আমি বয়ানটা শুনেছি অন্য লোকের কাছ থেকে–সেকথা তার অজানা নয়।
পাঞ্জাবীদের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, আপনার সনদ-সার্টিফিকেটে রয়েছে পাঞ্জাব গবর্নরের দস্তখত। আমাদের ক্ষুদ্র আফগানিস্থানেও গবর্নরের অভাব নেই। কিন্তু আগা মুজতবা আলীর কাগজে দস্তখত রয়েছে মশহুর শাইর রবীন্দ্রনাথের। তিনি পৃথিবীর সামনে সমস্ত প্রাচ্যদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন (চশম্ রওশন্ করদে অন্দ্)–।
ভদ্রলোকের ভারি শখ ছিল গুরুদেবকে কাবুলে নিমন্ত্রণ করার। তাঁর শুধু ভয় ছিল যে, দু শ মাইলের মোটর ঝাঁকুনি খেয়ে কবি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর তার কাব্যসৃষ্টিতে বাধা পড়ে তবে তাতে করে ক্ষতি হবে সমস্ত পৃথিবীর। কাবুল কবিকে দেখতে চায়, কিন্তু এমন দুর্ঘটনার নিমিত্তের ভাগী হতে যাবে কেন? আমি সাহস দিয়ে বলতুম, কবি ছফুট তিন ইঞ্চি উঁচু, তার দেহ সুগঠিত এবং হাড়ও মজবুত।
শেষটায় তিনি আল্লা বলে ঝুলে পড়ছিলেন কিন্তু আমান উল্লা বিলেত যাওয়ায় সে গ্রীষ্মে কবিকে আর নিমন্ত্রণ করা গেল না। শীতে বাচ্চা এসে উপস্থিত।
যাক্গে এসব কথা।
বাঁদিকে মুইন-উ-সুলতানের বাড়ি, খানিকটে এগিয়ে গিয়ে তার টেনিস কোর্ট। আজ মুইন-উস-সুলতানে ভাগ্যের হাতে টেনিস বল। কান্দাহার কাবুল তাকে নিয়ে লোফালুফি খেলছে।
এই ত মকতব-ই-হবীবিয়া। বাচ্চা আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় মকতটা দখল করে টেবিল চেয়ার, বই ম্যাপ পুড়িয়ে ফেলেছিল। এ শিক্ষায়তন আবার কখন খুলবে কে জানে? এখানেই আমি পড়িয়েছি। শীতে পুকুর জমে গেলে ছেলেদের সঙ্গে তার উপর স্কেটিং করেছি। গাছতলায় বসে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আঙুর কিনে খেয়েছি। মীর আসলমের কাছ থেকে কত তত্ত্বকথা শুনেছি।