মুসলমানের ছেলে, নিমতলা যাব না, যাব একদিন গোবরা— অবশ্য যদি এই কাবুলী-গর্দিশ কাটিয়ে উঠতে পারি। সেদিন কিছু সঙ্গে নিয়ে যাব না, সেকথাও জানি; কিন্তু তারই জন্য কি আজ সব কিছু কাবুলে ফেলে দেশে যেতে হবে? মক্স করলে সব জিনিসই রপ্ত হয়, এই কি খুদাতালার মতলব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ কুষ্টিয়ার লালন ফকির বলেছেন–
মরার আগে মলে শমন-জ্বালা ঘুচে যায়।
জানগে সে মরা কেমন, মুরশিদ ধরে জানতে হয়।
আবার আরো কে একজন, দাদু না কি, তিনিও তো বলেছেন,
দাদু, মেরা বৈরী মৈ মুওয়া মুকৈ ন্
মারে কোই।
(হে দাদু, আমার বৈরী আমি মরে গিয়েছে, আমাকে কেউ মারতে পারে না)।
কী মুশকিল। সব গুণীরই এক রা। শেয়ালকে কেন বৃথা দোষ দেওয়া। কবীরও তো বলেছেন,
তজো অভিমানা সীখো জ্ঞানা
সতগুরু সঙ্গত তরতা হৈ
কহৈঁ কবীর কোই বিরল হংস
জীবত হী জো মরতা হৈ।।
(অভিমান ত্যাগ করে জ্ঞান শেখো, সৎগুরুর সঙ্গ নিলেই ত্রাণ। কবীর বলেন, জীবনেই মৃত্যুকে লাভ করেছেন সে রকম হংসসাধক বিরল)
কিন্তু কবীরের বচনে বাঁচাও রয়ে গিয়েছে। গোবরার গোরস্তানে যাবার পূর্বেই মৃতের ন্যায় সবকিছুর মায়া কাটাতে পারেন এমন পরমহংস যখন বিরল তখন সে কস্ত করার দায় তো আমার উপর নয়।
ডোম শেষ পর্যন্ত কোন্ বাঁশ বেছে নিয়েছিল আমাদের প্রবাদে তার হদিস মেলে না। বিবেচনা করি, সেটা নিতান্ত কাঁচা এবং গিঁটে ভর্তি না হলে প্রবাদটার কোনো মানে হয়। এ-ডোম তাই শেষ পর্যন্ত কি দিয়ে দশ পৌণ্ডের পুঁটুলি বেঁধেছিল, সেকথা ফাঁস করে দিয়ে আপন আহাম্মুখির শেষ প্রমাণ আপনাদের হাতে তুলে দেবে না।
কিন্তু সেটা পুরানো ধুতিতে বাঁধা বেনের পুঁটুলিই ছিল লিগেজ বা সুটকেসের ভিতরে গোছানো মাল অন্য জিনিস কারণ দশ পৌণ্ড মালের জন্য পাঁচ পৌণ্ডী সুটকেস ব্যবহার করলে মালের পাঁচ পৌণ্ড গিয়ে রইবে হাতে সুটকেসটা। সুকুমার রায়ের কাক যে রকম হিসেব করতে সাত দুগুণে চোদ্দর নামে চার, হাতে রইল পেন্সিল।
অবশ্য জামা-কাপড় পরে নিলুম একগাদা একপ্রস্ত না। কর্তারাও উপদেশ পাঠিয়েছিলেন যে, প্রচুর পরিমাণে গরম জামাকাপড় না পরা থাকলে উপরে গিয়ে শীতে কষ্ট পাব এবং মৌলানার বউয়ের পা খড় দিয়ে কি রকম পেঁচিয়ে বিলিতী সিরকার বোতল বানানো হয়েছিল আবদুর রহমানের সে-বর্ণনাও মনে ছিল।
মৌলানা তার এক পাঞ্জাবী বন্ধুর সঙ্গে আগেই বেরিয়ে পড়েছিলেন।
আবদুর রহমান বসবার ঘরে প্রাণভরে আগুন জ্বালিয়েছে। আমি একটা চেয়ারে বসে। আবদুর রহমান আমার পায়ের কাছে।
আমি বললুম, আবদুর রহমান, তোমার উপর অনেকবার খামকা রাগ করেছি, মাফ করে দিয়ে।
আবদুর রহমান আমার দুহাত তুলে নিয়ে আপন চোখের উপর চেপে ধরল। ভেজা।
আমি বললুম, ছিঃ আবদুর রহমান, এ কি করছ? আর শোনন, যা রইল সব কিছু তোমার।
আমি জানি আমার পাঠক মাত্রই অবিশ্বাসের হাসি হাসবেন, কিন্তু তবু আমি জোর করে বলব, আবদুর রহমান আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে, তার চোখে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলুম লেখা রয়েছে,–
যেনাহং নামৃত স্যাং কিমহং তেন কুর্যাং?
রাস্তা দিয়ে চলেছি। পিছনে পুঁটুলি-হাতে আবদুর রহমান।
দু-একবার তার সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করলুম। দেখলুম সে চুপ করে থাকাটাই পছন্দ করছে।
প্রথমেই ডানদিকে পড়ল রুশ রাজদূতাবাস। দেমিদফ পরিবারকে কখনো ভুলব না। বলশফের আত্মাকে নমস্কার জানালুম।
তারপর কাবুল নদী পেরিয়ে সব-ই-দরিয়া হয়ে আর্কের দিকে চললুম। বেশীর ভাগ দোকানপাট বন্ধ— তবু দূর থেকেই দেখতে পেলুম পাঞ্জাবীর দোকান খোলা। দোকানদার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলুম, দেশে যাবেন না? মাথা নাড়িয়ে নীরবে জানালে না। তারপর বিদায়ের সালাম জানিয়ে মাথা নিচু করে দোকানের ভিতরে চলে গেল। আমি জানতুম, কারবার ফেলে এদের কাবুল ছাড়ার উপায় নেই, সব কিছু তৎক্ষণাৎ লুট হয়ে যাবে। অথচ এর চিত্ত এমনি বিকল হয়ে গিয়েছে যে, শেষ মুহূর্তে আমার সঙ্গে দুটি কথা বলবার মত মনের জোর এর আর নেই।
বিশ কদম পরে বাঁ দিকে দোস্ত মুহম্মদের বাসা। অবস্থা দেখে বুঝতে বেগ পেতে হল না যে, বাসা লুট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে তার কণামাত্র শোক হওয়ার কথা নয়। এ-বাবতে তিনি সোক্রাতেসের ন্যায় সোক্রাতেস যেমন তত্ত্বচিন্তায় বুদ হয়ে অন্য কোন বস্তুর প্রয়োজন অনুভব করতেন না, দোস্ত মুহম্মদ ঠিক তেমনি রসের সন্ধানে, অদ্ভূতের খোঁজে, গ্রোটেঙ্কের (উদ্ভটের) পিছনে এমনি লেগে থাকতেন যে, অন্য কোনো বস্তুর অভাব তাঁর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাতে পারত না। পতঞ্জলিও ঠিক এই কথাই বলেছেন। চিত্তবৃত্তিনিরোধের পন্থা বালাতে গিয়ে তিনি ঈশ্বর, এবং বীতরাগ মহাপুরুষদের সম্বন্ধে ধ্যান করতে উপদেশ দিয়েছেন কিন্তু সর্বশেষে বলছেন, যথাভিমতধ্যানাঘা, যা খুশী তাই দিয়ে চিত্তচাঞ্চল্য ঠেকাবে। অর্থাৎ ধ্যানটাই মুখ্য, ধ্যানের বিষয়বস্তু গৌণ। দোস্ত মুহম্মদের সাধনা রসের সাধনা।
আরো খানিকটে এগিয়ে বাঁ দিকে মেয়েদের ইস্কুল। বাচ্চার আক্রমণের কয়েক দিন পূর্বে এখানে কর্নেলের বউ তাঁর স্বামীর কথা ভেবে ডুকরে কেঁদেছিলেন। তিনি বেঁচে আছেন কিনা কে জানে। আমার পাশের বাড়ীর কর্নেলের মায়ের কান্না, ইস্কুলের কর্নেল বউয়ের কান্না আরো কত কান্না মিশে গিয়ে অহরহ খুদাতালার তখতের দিকে চলেছে। কিন্তু কেন? কবি বলেছেন,