আমারই রাত। কি কুক্ষণে তাকে একদিন গুরুদেবের কাবুলীওয়ালা গল্পটা ফার্সীতে তর্জমা করে শুনিয়েছিলুম, সে আজ সেই গল্প থেকে নজির তুলতে আরম্ভ করল। মিনি যখন অচেনা কাবুলীওয়ালাকে ভালবাসতে পারল, তখন আমার ভাইপো ভাইঝিরাই তাকে ভালবাসবে না কেন?
সব হবে, কিন্তু তুমি যাবে কি করে?
সে আমি দেখে নেব।
ছোট্ট শিশু মায়ের কাছে যে রকম অসম্ভব জিনিস চায়। কোনো কথা শুনতে চায় না, কোনো ওজর আপত্তিতে কান দেয় না।
এত দীর্ঘকাল ধরে আবদুর রহমান আমার সঙ্গে কখনো কথা কাটাকাটি করেনি। আমি শেষটায় নিরুপায় হয়ে বললুম, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কি রকম কষ্ট হচ্ছে তুমি জানো, তুমি সেটা আর বাড়িয়ো মা। তোমাকে আমার শেষ আদেশ, তুমি এখানে থাকবে এবং যে মুহূর্তে পানশির যাবার সুযোেগ পাবে, সেই মুহূর্তেই বাড়ি চলে যাবে।।
আবদুর রহমান চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, তবে কি হুজুর আর কাবুল ফিরে আসবেন না?
আমি কি উত্তর দিয়েছিলুম, সে কথা দয়া করে আর শুধাবেন না।
———-
* অনুবাদকের নাম ভুলে যাওয়ায় তাঁর কাছে লজ্জিত আছি।
**উনবিংশ অধ্যায় পশ্য।
৪২. শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল, আবদুর রহমান। সঙ্গে সঙ্গে সে এসে ঘরে ঢুকল। রুটি, মমলেট, পনির, চা। অন্যদিন খাবার দিয়ে চলে যেত, আজ সামনে দাঁড়িয়ে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল। কী মুশকিল।
মৌলানা এসে বললেন, চিরকুটে লেখা আছে, মাথাপিছু দশ পৌণ্ড লগেজ নিয়ে যেতে দেবে। কি রাখি, কি নিয়ে যাই?
আমি বললুম, যা রেখে যাবে তা আর কোনোদিন ফিরে পাবে না। আমি আবদুর রহমানকে বলেছি পানশির চলে যেতে। বাড়ি পাহারা দেবার জন্য কেউ থাকবে না, কাজেই সবকিছু লুট হবে।
কারো বাড়িতে সব কিছু সমঝিয়ে দিয়ে গেলে হয় না?
আমি বললুম, এ পরিস্থিতিটা একদিন হতে পারে জেনে আমি ভিতরে ভিতরে খবর নিয়েছিলুম। শুনলুম, যখন চতুর্দিকে লুটতরাজের ভয়, তখন কাউকে মালের জিম্মাদারি নিতে অনুরোধ করা এ দেশের রেওয়াজ নয়। কারণ কেউ যদি জিম্মাদারি নিতে রাজীও হয়, তখন তার বাড়িতে ডবল মালের আশায় লুটের ডবল সম্ভাবনা। মালপত্র যখন সদর রাস্তা দিয়ে যাবে, তখন ডাকাতেরা বেশ করে চিনে নেবে মালগুলো কোন্ বাড়িতে গিয়ে উঠল।
বলে তো দিলুম মৌলানাকে সব কিছু প্রাঞ্জল ভাষায় কিন্তু ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যখন চারিদিকে তাকালুম, তখন মনে যে প্রশ্ন উঠল তার কোনো উত্তর নেই। নিয়ে যাব কি, আর রেখে যাব কি?
ঐ তো আমার দুভলুম রাশান অভিধান। এরা এসেছে মস্কো থেকে ট্রেনে করে তাশক, সেখান থেকে মোটরে করে আমুদরিয়া, তারপর খেয়া পেরিয়ে, খচ্চরের পিঠে চেপে সমস্ত উত্তর আফগানিস্থান পিছনে ফেলে, হিন্দুকুশের চড়াই-ওতরাই ভেঙে এসে পৌঁচেছে কাবুল। ওজন পৌণ্ড ছয়েক হবে।
আমি সাহিত্য সৃষ্টি করি না, কাজেই পাণ্ডুলিপির বালাই নেই–মৌলানার থেকে সেদিক দিয়ে আমার কপাল ভালো কিন্তু শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের ক্লাশে বলাকা, গোরা, শেলি, কীটস সম্বন্ধে যে গাদা গাদা নোট নিয়েছিলুম এবং মূর্খের মত এখানে নিয়ে এসেছিলুম, বরফবর্ষণের দীর্ঘ অবসরে সেগুলোকে যদি কোন কাজে লাগানো যায়, সেই ভরসায়, তার কি হবে? ওজন তো কিছু কম নয়।
আর সব অভিধান, ব্যাকরণ, মিনুদির দেওয়া পূরবী, বিনোদের দেওয়া ছবি, বন্ধুবান্ধবের ফটোগ্রাফ, আর এক বন্ধুর জন্য কাবুলে কেনা দুখানা বোখার কার্পেট? ওজন তিন লাশ।
কাপড়চোপড়? দেরেশি-পাগল কাবুলের লৌকিকতা রক্ষার জন্য স্মোকিঙ, টেল, মর্নিংসুট (কাবুলের সরকারী ভাষায় ব জুর দেরেশি!)। এগুলোর জন্য আমার সিকি পয়সার দরদ নেই কিন্তু যদি জর্মনী যাবার সুযোগ ঘটে, তবে আবার নূতন করে বানাবার পয়সা পাব কোথায়?
ভুলেই গিয়েছিলুম। এক জোড়া চীনা ভাজ। পাতিনেবুর মত রং আর চোখ বন্ধ করে হাত বুলোলে মনে হয় যেন পাতিনেবুরই গায়ে হাত বুলোচ্ছি, একটু জোরে চাপ দিলে বুঝি নখ ভিতরে ঢুকে যাবে।
কত ছছাটখাটো টুকিটাকি। পৃথিবীর আর কারো কাছে এদের কোনো দাম নেই, কিন্তু আমার কাছে এদের প্রত্যেকটি আলাউদ্দীনের প্রদীপ।
সোক্রাতেসকে একদিন তার শিষ্যের পাল শহরের সবচেয়ে সেরা দোকান দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। সে-দোকানে দুনিয়ার যত সব দামী দামী প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় জিনিস, অদ্ভুত অদ্ভুত বিলাসসম্ভার, মিশর বাবিলনের কলা-নিদর্শন, পাপিরসের বাণ্ডিল, আলকেমির সরঞ্জাম সব কিছুই ছিল। সোক্রাতেসের চোখের পলক পড়ে না। এটা দেখছেন, সেটা নাড়ছেন আর চোখ দুটো ছানাবড়ার সাইজ পেরিয়ে শেষটায় সসারের আকার ধারণ করেছে। শিষ্যেরা মহাখুশী গুরু যে এত কৃচ্ছ সাধন আর ত্যাগের উপদেশ কপচান সে শুধু কোনো সত্যিকার ভালো জিনিস দেখেননি বলে— এইবার দেখা যাক, গুরু কি বলেন। স্বয়ং প্লাতো গুরুর বিহ্বল ভাব দেখে অস্বস্তি অনুভব করছেন।
দেখা শেষ হলে সোক্রাতেস করুণকণ্ঠে বলেন, হায়, হায়। দুনিয়া কত চিত্র বিচিত্র জিনিসে ভর্তি যার একটারও আমার প্রয়োজন নেই।
আমার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি হৃদয়ঙ্গম করলুম, সোক্রাতেসে আমাতে মাত্র একটি সামান্য তফাত এ ঘরের প্রত্যেকটি জিনিসেরই আমার প্রয়োজন। ব্যস–ঐ একটি মাত্র পার্থক্য। ডার্বি জিতেছে ৫৩৭৮৬ নম্বরের টিকিট। আমি কিনেছিলুম ৫৩৭৮৫ নম্বরের টিকিট। তফাতটা এমন কি হল?