আবদুর রহমান নিশ্চয়ই ফলিতজ্যোতিষ জানে। দু মিনিটের ভিতর ক্ষুধা গেল। পাঁচ মিনিট পরে পেটের ভিতর মহারানীর রাজত্ব বিলকুল ঠাণ্ডা। কিন্তু তারপর আরম্ভ হল বিপ্লব। সে কি অসম্ভব হচড়পাঁচড় আর আইঢাই। খাটে শুয়ে পড়েছি, অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ করছি আর গরমের চোটে কপাল দিয়ে ঘাম বেরচ্ছে। মৌলানারও একই অবস্থা। তিনিই প্রথম বললেন, বড্ড বেশী খাওয়া হয়ে গিয়েছে।
প্রাণ যায় আর কি। আর বেশী খেলে দেখতে হত না। ও, আবদুর রহমান, এদিকে আয় বাবা।
আবদুর রহমান এসে বলল, আমার কাছে সুলেমানী মুন আছে, তারই খানিকটা দেব?
এরকম গুণীর চন্নামেহত্যা খেতে হয়, এর হাতের হজমী ডাঙ্গস হয়ে আমার পেটের বিপ্লব নিশ্চয়ই কাবু করে নিয়ে আসবে। বললুম, তাই দে, বাবা। কিন্তু গিলতে গিয়ে দেখি, শ্রাদ্ধ ভোজনের পর আমাদের ব্রাহ্মণের গুলী গিলতে গিয়ে যে-অবস্থা হয়েছিল আমারও তাই। শুনেছি অত্যধিক সংযম করে মুনিঋষিরা উধরেতা হন, আমি অত্যধিক ভোজন করে উদ্ধ-ভোজা হয়ে গিয়েছি।
নুন খেয়ে আরাম বোধ করলুম। আবদুর রহমানকে আশীর্বাদ করে বললুম, বাবা তুমি দারোগা হও। ইচ্ছে করেই রাজা হও বললুম না, কাবুলে রাজা হওয়ার কি সুখ সে তো চোখের সামনে স্পষ্ট দেখলুম।
উত্তেজনার শেষ নাই। আবদুর রহমানের পিছনে ঢুকল উর্দি পরা এক মূর্তি। ব্রিটিশ রাজদূতাবাসের পিয়ন। দেখেই মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। মৌলানাকে বললুম, তদারক করো তো ব্যাপারটা কি?
একখানা চিরকুট। তার মর্ম আগামী কল্য দশটার সময় যে প্লেন ভারতবর্ষ যাবে তাতে মৌলানা ও আমার জন্য দুটি সীট আছে। আনন্দের আতিশয্যে মৌলানা সোফার উপর শুয়ে পড়লেন। আমাদের এমনই দুরবস্থা যে, পিয়নকে বখশিশ দেবার কড়ি আমাদের গাঁটে নেই।
ফেবার না রাইট হিসেবে জায়গা পেলুম তার চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হল না। আবদুর রহমান ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেচুপ করে চলে গেল। মৌলানার আনন্দ ধরে না। বিবি সম্বন্ধে তাঁর দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই তিনি তাকে কাবুল নিয়ে এসেছিলেন বলে নূতন বউ বাড়ির আর পাঁচ জনের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাননি। এখন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি কি করে দিন কাটাচ্ছেন সে কথা ভেবে ভেবে ভদ্রলোক দাড়ি পাকিয়ে ফেলেছিলেন।
আমিও কম খুশী হইনি। মা বাবা নিশ্চয়ই অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। বাবা আবার দি স্টেটমেন থেকে আরম্ভ করে প্রিন্টেড এণ্ড পাবলিশড বাই পর্যন্ত খুটিয়ে খুটিয়ে কাগজ পড়েন। অ্যারোপ্লেনে করে ব্রিটিশ লিগেশনের জন্য ভারতীয় খবরের কাগজ আসত। তারই একখানা মৌলানা কি করে যোগাড় করেছিলেন এবং তাতে আফগান রাষ্ট্রবিপ্লব ও কাবুলের বর্ণনা পড়ে বুঝলুম খবরের কাগজের রিপোর্টারের কল্পনাশক্তি সত্যকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। গাছে আর মাছে বানানো গল্প, পেশাওয়ারে বোতলের পাশে বসে লেখা। এ বর্ণনাটি বাবা পড়লেই হয়েছে আর কি। আমার খবরের আশায় ডাকঘরে থানা গাড়বেন।
মৌলানা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। মানুষ যখন ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন দেখে তখন কথা কয় কম।
ওদিকে এখনো কান্না থামেনি। পাশের বাড়ির দরজা খুললে এখনো মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ আসে। আবদুর রহমান বলেছে, কর্নেলের বুড়ী মা কিছুতেই শান্ত হতে পারছেন না। ঐ তাঁর
একমাত্র ছেলে ছিলেন।
মায়ে মায়ে তফাত নেই। বীরের মা যে রকম ডুকরে কাঁদছে ঠিক সেই রকমই শুনেছি দেশে, চাষা মরলে।
ঘুমিয়ে পড়ব পড়ব এমন সময় দেখি খাটের বাজুতে হাত রেখে নিচে বসে আবদুর রহমান। জিজ্ঞেস করলুম, কি বাচ্চা?
আবদুর রহমান বলল, আমাকে সঙ্গে করে আপনার দেশে নিয়ে চলুন।
পাগল নাকি? তুই কোথায় বিদেশ যাবি? তোর বাপ মা, বউ? কোনো কথা শোনে না, কোনো যুক্তি মানে না। অ্যারোপ্লেনে তোকে নেবে কেন? আর তারা রাজী হলেও বাচ্চার কড়া হুকুম রয়েছে কোনো আফগান যেন দেশত্যাগ না করে। তোক নিলে বাচ্চা ইংরেজের গলা কেটে ফেলবে না? ওরে পাগল, আজ কাবুলের অনেক লোক রাজী আছে প্লেনে একটা সীটের জন্য লক্ষ টাকা দিতে।
নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। বলে, আমি রাজী হলে সে সকলের হাতে পায়ে ধরে এক কোণে একটু জায়গা করে নেবে।
কী মুশকিল। বললুম, তুই মৌলানাকে ডাক। তিনি তোকে সব কিছু বুঝিয়ে দেবেন। আবদুর রহমান যায় না। শেষটায় বলল, উনি আমার কে?
তারপর ফের অনুনয়বিনয় করে। তবে কি তার খেদমতে বড় বেশী ত্রুটি গলদ, না আমার বাপ মা তাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে চটে যাবেন? আমার বিয়ের শাদিয়ানাতে বন্দুক ছুড়বে কে?
আবদুর রহমান পানশির আর বরফ এই দুই বস্তু ছাড়া আর কোনো জিনিস গুছিয়ে বলতে পারে না। তার উপর সে আমার কাছ থেকে কোনো দিন কোনো জিনিস, কোনো অনুগ্রহ চায়নি। আজ চাইতে গিয়ে সে যেসব অনুনয়বিনয়, কাকুতিমিনতি করল সেগুলো গুছিয়ে বললে তো ঠিকঠিক বলা হবে না। ওদিকে তার এক একটা কথা, এক একটা অভিমান আমার মনের উপর এমনি দাগ কেটে যাচ্ছিল যে, আমিও আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলুম না। আর বলবই বা কি ছাই। সমস্ত জিনিসটা এমনি অসম্ভব, এমনি অবিশ্বাস্য যে, তার বিরুদ্ধে আমি যুক্তি চালাবো কোথায়? ভূতকে কি পিস্তলের গুলী দিয়ে মারা যায়?
আমি দুঃখে বেদনায় ক্লান্ত হয়ে চুপ করে গেলে আবদুর রহমান ভাবে সে বুঝি আমাকে শায়েস্তা করে এনেছে। তখন দ্বিগুণ উৎসাহে আরও আবোল তাবোল বকে। কথার খেই হারিয়ে ফেলে এক কথা পঞ্চাশ বার বলে। আমার মা বাপকে এমনি খেদমত করবে যে, তারা তাকে গ্রহণ না করে থাকতে পারবেন না। আমি যদি তখন বলতুম যে, আমার মা গরীব কাবলীওলাকেও দোর থেকে ফেরান না তা হলে আর রক্ষে ছিল না।