আবদুর রহমান আমাদের পরিচয়ের পয়লা রাত্তিরে যে ডিনার ছেড়েছিল এ ডিনার সে মালেরই সিল্কে বাঁধানন, প্রিয়জনের উপহারোপযোগী, পুজোর বাজারের রাজ-সংস্করণ। জানটা তর হয়ে গেল। মৌলানা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
জিন্দাবাদ গাজী আবদুর রহমান খান।
আমি গলা এক পর্দা চড়িয়ে দোস্ত মুহম্মদী কায়দায় বললুম,
কমরৎ ব্ শিকনদ, খুদা তোরা কোর সাজদ্, ব্ পুন্দী, ব্ তরকী (তোর কোমর ভেঙে দুটুকরো হোক, খুদা তোর দু চোখ কানা করে দিন, তুই ফুলে ওঠে ঢাকের মত হয়ে যা, তারপর টুকরো টুকরো হয়ে ফেটে যা)।
মৌলানা বজ্রাহত। গুণীলোক, এসব কটুকাটব্যের সন্ধান তিনি পাবেন কি করে? কিন্তু বালাই দূর করবার এই জনপদ-পন্থা আবদুর রহমান বিলক্ষণ জানে।** অদৃশ্য সাবানে হাত কচলাতে কচলাতে বলল, হাত ধুয়ে নিন সায়েব, গরম জল আছে।
কি বললে? গরম জল! আ-হা-হা। কতদিন বাদে গরম জলের সুখস্পর্শ পাব। কোথায় লাগে তার কাছে নববর্ষণে স্তনান্ধয়া বসন্তসেনার জলাভিষেক, কোথায় লাগে তার কাছে মুগ্ধ চারুদন্তের বিহ্বল প্রশস্তি। বললুম, বরাদর আবদুর রহমান, এই গরম জল দিয়ে তুমি যেন তোমার ডিনারখানা সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দিলে।
আবদুর রহমানের খুশীর অন্ত নেই। আমার কোনো কথার উত্তর দেয় না, আর বেশী প্রশংসা করলে শুধু বলে, আলহামদুলিল্লা অর্থাৎ খুদাতালাকে ধন্যবাদ। যতক্ষণ এটা ওটা গুছোচ্ছিল আমার বার বার নজর পড়ছিল তার হাত দুখানা কি রকম শুকিয়ে গিয়েছে, আর বাসন-বর্তন নাড়াচাড়া করার সময় অল্প অল্প কাঁপছে।
মৌলানা আমাকে সাবধান করে দিলেন, প্রতি গ্রাস যেন বত্রিশবার চিবিয়ে খাই। কাজের বেলা দেখা গেল, ডাকগাড়ি থেকে নেমে গোরারা যে-রকম রিফ্রেশমেন্টরুমে খানা খায় আমরা সেই তালেই খাচ্ছি। পেটের এক কোণ ভর্তি হতেই আমি আবদুর রহমানকে লক্ষ্য করে বললুম, এরকম রান্না পেলে আমি আরো কিছুদিন কাবুলে থাকতে রাজী আছি। সে-দুর্দিনে এর চেয়ে বড় প্রশংসা আর কি করা যায়।
কিন্তু মৌলানা পোষিত-ভার্য। পেট খানিকটা ভরে যাওয়ায় তাঁর বিরহযন্ত্রণাটা যেন মাথা খাড়া করে দাঁড়াল। বললেন, না,
সন্গে ওতন্ অজ্ তখতে সুলেমান বেশতর,
খারে ওতন অজ গুলে রেহান বেহতর,
ইউসুফ কি দর মিস পাদশাহী মীকরদ
মীগুফৎ গদা বুদনে কিনান খুশতর।
দেশের পাথর সুলেমান শার
তখতের চেয়ে বাড়া,
বিদেশের ফুল হার মেনে যায়
দিশী কাঁটা প্রাণ কাড়া।
মিশর দেশের সিংহাসনেতে
বসিয়া ইউসুফ রাজা
কহিত, হায়রে, এর চেয়ে ভালো
কিনানে ভিখারী সাজা।
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম,
ইউসুফে গুম্ গশ্তে বাজ্ আয়দ ব্ কিনান,
গম্ ম্ খুর্।
কুলবয়ে ইহজান্ শওদ রুজি গুলিস্তান,
গম্ ম্ খুর্।।
দুঃখ করো না হৃরানো ইউসুফ
কিনানে আবার আসিব ফিরে
দলিত শুষ্ক এ মরু পুনঃ
হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে।
(কাজী নজরুল ইসলাম)
কিন্তু বয়েত-বাজী বা কবির লড়াই বেশীক্ষণ চলল না। সাঁতারের সময় পয়লা দম ফুরিয়ে যাবার খানিকক্ষণ পরে মানুষ যে রকম দুসরা দম পায়, আমরা ঠিক সেই রকম খানিকক্ষণ ক্ষান্ত দিয়ে আবার মাথায় গামছা বেঁধে খেতে লেগেছি। এদিকে দেখি সবকিছু ফুরিয়ে আসছে প্রথম পরিবেষণে কম মেকদারে দেওয়ার তালিম আবদুর রহমান আমার কাছ থেকেই পেয়েছে কিন্তু আর কিছু আনছে না। থাকতে না পেরে বললুম, আরো নিয়ে এস।
আবদুর রহমান চুপ। আমি বললুম, আরে নিয়ে এস। তখন বলে কি না সবকিছু ফুরিয়ে গিয়েছে। মৌলানা আর আমি তখন যেন রক্তের স্বাদ পেয়ে হন্যে হয়ে উঠেছি। আমি ভয়ঙ্কর। চটে গিয়ে বললুম, তোমার উপযুক্ত শিক্ষা হওয়ার প্রয়োজন। যাও, তোমার নিজের জন্য যা রেখেছে তাই নিয়ে এস। আবদুর রহমান যায় না। শেষটায় বললে, সে সব কিছুই পরিবেষণ করে দিয়েছে, নিজে রুটি পনির খাবে।
আমি তার কঞ্জুসি দেখে ক্ষিপ্ত প্রায়। উন্মাদ, মূর্খ, হস্তী হেন শব্দ নেই যা আমি গালাগালে ব্যবহার করিনি। মৌলানা শান্ত প্রকৃতির লোক, কড়া কথা মুখ দিয়ে বেরোয় না। তিনি পর্যন্ত আপন বিরক্তি সুস্পষ্ট ফার্সী ভাষায় জানিয়ে দিলেন। আবদুর রহমান চুপ করে সব কিছু শুনল। হাসল না সত্যি কিন্তু কই, মুখোনা একটু মলিনও হল না। আমি আরো চটে গিয়ে বললুম, তোমাকে চাকর রাখার ঝকমারিটা বোঝাবার এই কি মোকা? এর চেয়ে তো শুকনো রুটি আর নুনই ভালো ছিল। কথা যতই বলছি চটে যাচ্ছি ততই বেশী। শেষটায় বললুম, আমি মরে গেলে আচ্ছা করে খানা বেঁধে আর প্রচুর পরিমাণে, বুঝলে তো?— মসজিদে নিয়ে গিয়ে আমার ফাতেহা বিলিয়ো। অর্থাৎ আমার পিণ্ডি চটকিয়ো।
তখন মৌলানার দিকে তাকিয়ে বলল, দুলহমা সবুর করুন, পেট আপনার থেকেই ভরে যাবে।
মৌলানা পর্যন্ত রেগে টং। পুরুষ্টু পাঁঠার মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে পাত্রী সায়েবেরা গাঁয়ে ঢুকে ক্ষুধাতুর চাষাকে এই রকম উপদেশ দেয় বটে। স্বর্গরাজ্য ফর্গরাজ্য কি সব বলে। কিন্তু আবদুর রহমান খালি পেটে উপদেশটা দিয়েছে বলে মৌলানা দাড়িতে হাত রেখে অভিসম্পাত দিতে দিতে থেমে গেলেন। আমি বললুম, বিদ্রোহে কতলোক গুলী খেয়ে মরল, তোমার জন্য।
ততক্ষণে আবদুর রহমান বেরিয়ে গিয়েছে। একেই বলে কৃতজ্ঞতা। যে আবদুর রহমানকে পাঁচ মিনিট আগে সুলেমানের তখতে বসবার জন্য ল্যাজারসে সিংহাসন অর্ডার দেব দেব করেছিলুম সেই আবদুর রহমানকে তখন জাহান্নমে পাঠাবার জন্য টিকিট কাটবার বন্দোবস্ত করছি।