চাষার ছেলের হাত। অল্পবয়স থেকে কুহিন্তানের (কুহ=পর্বত) শক্ত জমিতে হাল ধরে ধরে দুখানা হাতে কড়া পড়ে গিয়ে চেহারা হয়েছে মোষের কাধের মত। নখে চামড়ায় কোনো তফাত নেই, আর হাতের রেখা দেখে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আমার ভক্তি বেড়ে গেল। লাঙলের ঘষায় হাতে অবশিষ্ট রয়েছে কুল্লে দেড়খানা রেখা। আয়ুরেখা তেলের ইসপার উপার, হেতলাইন নেই, আর হার্ট লাইন তেলোর মধ্যিখানে এসে আচম্বিতে মরুপথে হারালো ধারা। ব্যস। এই দেড়খানা লাইন নিয়ে সে সংসার চালাচ্ছে, জুপিটার, ভিনাস, সলমনের মাউন্ট রেখা কোনো কিছুর বালাই নেই। আর আঙুলগুলো এমনি কুষ্ঠরোগীর মত এবড়ো-থেবড়ো যে, হাতের আকার জ্যোতিষশাস্ত্রের কোন পর্যায়েই পড়ে না। না পড়ারই কথা, কারণ ডাকাত-গুষ্ঠির ছেলে কর্নেল হয়েছে সবসুদ্ধ কটা, আর তাদের সংস্পর্শে এসেছেন কজন বরাহমিহির কজন কেইন?
আবদুর রহমান ঝুড়ির সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে।
মৌলানা কর্নেলকে ধন্যবাদ দিয়ে আবদুর রহমানকে ঝুড়ি রান্নাঘরে নিয়ে যেতে বললেন। সে ঝুড়ি নিয়ে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু ঘর থেকে বেরল না। আমি নিরুপায় হয়ে কর্নেলকে বললুম, রাত্রে এখানেই খেয়ে যাও।
আবদুর রহমান তৎক্ষণাৎ রান্নাঘরে চলে গেল।
কর্নেল বলল, আমাকে মাফ করতে হবে হুজুর। বাদশার সঙ্গে আমার রাত্রে খানা খাওয়ার হুকুম।
মৌলানা শুধালেন, বাদশা কি খান?
কর্নেল বললেন, সেই রুটি পনির আর কিসমিস। কচিৎ কখনো দুমুঠো পোলাও। বলেন, যে-খানা খেয়ে আমান উল্লা কাপুরুষের মত পালাল, আমি সেখানা খেলে কাপুরুষ হয়ে যাব না? তারপর দুষ্ট হাসি হেসে বলল, আমি ওসব কথায় কান দিই না। আমান উল্লার বাবুর্চিই এখনো রাজবাড়িতে ঝাঁধে। আমি তাই পেট ভরে খাই।
কর্নেল যাবার সময় বলে গেল, আমি যেন আহারাদি সম্বন্ধে আর দুশ্চিন্তা না করি।
দশ মিনিটের ভিতর আবদুর রহমান কর্নেলের আনা কাঠ দিয়ে ঘরে আগুন জ্বেলে দিল।
আমি সে-আগুনের সামনে বসে সর্বাঙ্গে, মাংসে, রক্তে, হাড়ে, মজ্জায়, স্নায়ুতে স্নায়ুতে যে সঞ্জীবনীবহ্নির অভিযান অনুভব করলুম, তার তুলনা বা বর্ণনা দিতে পারি এমনতরো শারীরিক অভিজ্ঞতা বা আলঙ্কারিক ক্ষমতা আমার নেই। রোদে-ফাটা জমি যে রকম সেচের জল ফাটলে ফাটলে ছিদ্রে ছিদ্রে, কণাকণায় শুষে নেয়, আমার শরীরের অণুপরমাণু যেন ঠিক তেমনি আগুনের গরম শুষে নিল। আমার মনে হল, ভগীরথ যে-রকম জহ্ন ধারা নিয়ে সাগররাজের সহস্র সন্তানের প্রাণদান করার বিজয়অভিযানে বেরিয়েছিলেন স্বয়ং ধন্বন্তরি ঠিক সেইরকম সূক্ষ্মশরীর ধারণ করে বহ্নিধারা সঙ্গে নিয়ে আমার অঙ্গে প্রবেশ করলেন।
মুদ্রিত নয়নে শিহরণে শিহরণে অনুভব করলুম প্রতি ভস্মকণায় জহ্নকণার স্পর্শ, আমার শিশিরবিদ্ধ অচেতন অণুতে অণুতে কৃশানুর দীপ্ত স্পর্শের প্রাণপ্রতিষ্ঠার অভিষেক।
সমস্ত দেহমন দিয়ে বুঝলুম আর্য ঐতিহ্য, ভারতীয় সভ্যতা, সনাতন ধর্মের প্রথম শব্দব্রহ্ম ঋগ্বেদের প্রথম পদে কেন
‘অগ্নিমীড়ে পুরোহিতম’ রূপে প্রকাশিত হয়েছেন।
এবং সেমিতি ধর্মজগতেও তো তাই। ইহুদী, খ্ৰীষ্ট, ইসলাম তিন ধর্মই সম্মিলিত কণ্ঠে স্বীকার করে, একমাত্র মানুষ যিনি পরমেশ্বরের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি মুসা (মোজেস) এবং তখন পরমেশ্বর তাঁর প্রকাশের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন রুদ্ররূপে বা তজল্লিতে। মুসা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন, তখন দেখলেন তার সামনের সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে।
গ্রীক দেবতা প্রমিথিয়ুস ও দেবরাজ জুপিটারে কলহ হয়েছিল অগ্নি নিয়ে। মানব-সভ্যতা আরম্ভ হয় প্রমিথিয়ুসের কাছ থেকে পাওয়া সেই অগ্নি দিয়ে। নলরাজ ইন্ধন প্রজ্জালনে সুচতুর ছিলেন বলেই কি তিনি দেবতাদের ঈর্ষাভাজন হলেন? নল শব্দের অর্থ চোঙা, প্রমিথিয়ুসও আগুন চুরি করেছিলেন চোঙার ভিতরে করে।
ভারতীয় আর্য, গ্রীক আর্য দুই গোষ্ঠী, এবং তৃতীয় গোষ্ঠী ইরানী আর্য জরথুস্ত্রী—সকলেই অগ্নিকে সম্মান করেছিলেন। হয়ত এর সকলেই এককালে শীতের দেশে ছিলেন এবং অগ্নির মূল্য এরা জানতেন, কিন্তু সেমিতি ভূমি উষ্ণপ্রধান, সেখানে অগ্নিমাহাত্ম্য কেন? তবে কি মরুভূমির মানুষ সূর্যের একচ্ছত্রাধিপত্য সম্বন্ধে এতই সচেতন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একচ্ছত্রাধিপতির রুদ্ররূপ বা তজল্লিতে অগ্নিরই আভাস পায়?
আগুনের পরশমণির ছোঁয়া লেগে শরীর ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হচ্ছে আর ওদিকে মগজে হুশ হুশ করে থিয়োরর পর থিয়োরি গড়ে উঠছে; নিজের পাণ্ডিত্যের প্রতি এতই গভীর শ্রদ্ধা হল যে, সাধু, সাধু বলে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াতে গিয়ে হাতটা মচকে গেল। এমন সময় হঠাৎ মনে পড়ে গেল, শয়তান, ডেভিল, বিয়ালজিবাব, লুসিফার সবাই আগুনের তৈরী; তারা আগুনের রাজা। নরকের আবহাওয়া : আগুন দিয়ে ঠাসা, এদের শরীর আগুনে গড়া না হলে এরা সেখানে থাকবেন কি প্রকারে?
হায়, হায়, আমার বহু মূল্যবান থিয়োরিখানা শয়তানের পাল্লায় পড়ে নরকের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল!
কোথায় লাগে নরগিস, চামেলিয়াকে বাখানিয়া কবিতা লেখে কোন্ মূর্খ। বিরয়ানি কোর্মা কাবাব —মুসল্লম থেকে যে খুশবাই বেয়োয় তার কাছে সব ফুল হাতো মানেই, প্রিয়ার চিকুসুবাসও তার কাছে নস্যি।
চোখ মেলে দেখি, আবদুর রহমান বেনকুয়েট সাজিয়েছে। মৌলানা ফপরদালালি করছেন আর আমার বেরাল দুটো একমাস অজ্ঞাত বাস করে ফের খানা-কামরায় এসে উন্নাসিক হয়ে মাইডিয়ার মাইডিয়ার আওয়াজ বের করছে।