এতদিনে জানলেন, যে কাঁদন কাঁদলেম
সে কাহার জন্য
ধন্য এ-জাগরণ, ধন্য এ-ক্রন্দন, ধন্য রে ধন্য!
স্থির করলুম, ফুরসৎ পাওয়া মাত্রই ‘প্রবাসী’তে বঙ্গের বাহিরে বাঙালী পর্যায়ে আমার কীর্তির খবরটা পাঠাতে হবে।
বললুম, তাহলে বৎস, যদি অনুমতি দাও তবে বাড়ি যাই।
মিলিটারি কণ্ঠে বলল, আপনাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিচ্ছি। রাস্তায় অনেক ডাকু। বলে অজানায় সে আপন সঙ্গীদের দিকেই তাকালো। তাই সই। দান উল্টে গিয়েছে। এখন তুমি গুরু, আমি শিষ্য।
আমাকে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়ে আমার বসবার ঘরে কর্নেল দুদণ্ড রসালাপ করলেন, আমান উল্লাকে শাপমন্তি ও মৌলানাকে মিলিটারি স্ট্যাটেজি সম্বন্ধে তালিম দিলেন।
আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাবার সময় কর্নেল আবদুর রহমানের খাসকামরায় ঢুকল। কাবুলের ছাত্রেরা গুরুগৃহে ভৃত্যের সঙ্গে ধূমপান করে। কিন্তু আবদুর রহমান তো বিপদে পড়ল, বহুকাল থেকে তার তামাক বাড়ন্ত। লোকটা আবার ধাপ্পা দিতে জানে না, আমার সঙ্গে এতদিন থেকেও। কিন্তু তাতে আশ্চর্য হবারই বা কি? বনমালীও গুরুদেবের সঙ্গে বাস করে কবিতা লিখতে শেখেনি।
মৌলানা বললেন, সমস্ত সকাল কাটালুম ব্রিটিশ লিগেশন আর বাচ্চার পররাষ্ট্র দফতরে। কান্নাকাটিও কম করিনি। দাড়িতে হাত রেখে শপথ করে বললুম, দুমাস হল শুকনো রুটি ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি। আসছে পরশু থেকে সে-রুটিও আর জুটবে না। ব্রিটিশ লিগেশনে বললুম, কাবুলের পিজরা থেকে মুক্তি দাও। পররাষ্ট্র দফতরে বললুম, দুমুঠো অন্ন দাও।
আমি বললুম, পররাষ্ট্র-দফতর আর মুদির দোকান এক প্রতিষ্ঠান নাকি? তোমার উচিত ছিল বলা
মুরগে সইয়াদ তু অম্ ইফতাদে অম্ দর দামে ইশ্ক্।
ইয়া ব্ কুশ্, ইয়া দানা দেহ্ অজ কফস আজাদ কুন।।
পাখির মতন বাঁধা পড়ে গেছি কঠিন প্রেমের ফাঁদ।
হয় মেরে ফেলো, নয় দানা দাও, নয় খোলো এই বাঁধ।।
তুমি তো মাত্র দুটো পন্থা বালালে : হয় দানা দাও, নয় খোলো বাঁধ। তৃতীয়টা বললে না কেন? নয় মেরে ফেলো। আপ্তবাক্যের বিকলাঙ্গ উদ্ধতি গোবধের ন্যায় মহাপাপ।
মৌলানা বললেন, তাই সই। শিক-কাবাব করে খাবো।
শীতে ধুঁকছি, যেন কম্প দিয়ে ম্যালেরিয়া জ্বর। মাঝে মাঝে তন্দ্রা লাগছে। কখনো মনে হয় খাট থেকে পড়ে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে পা দুটো ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ সটান লম্বা হয়ে যায়। কখনো চীৎকার করে উঠি, আবদুর রহমান আবদুর রহমান। কেউ আসে না। কখনো দেখি আবদুর রহমান খাটের বাজুতে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে; কিন্তু কই, তাকে তো ডাকিনি। শুনি, যে দু-চারটে সামান্য মন্ত্র সে জানে তাই বিড় বিড় করে পড়ছে।
তার সঙ্গে দুঃস্বপ্ন; অ্যারোপ্লেনে বসে আছি, বাচ্চার ডাকাতদল আটটা রাইফেল বাগিয়ে ছুটে আসছে, অ্যারোপ্লেন থামাবার জন্য, এঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে না। এক সঙ্গে আটটা রাইফেলের শব্দ। ঘুম ভেঙে যায়। শুনি সত্যিকার রাইফেলের আওয়াজ আর চীৎকার। পাড়ায় ডাকু পড়েছে।
আর দেখি মা ইলিশমাছ ভাজছেন।
মাগো।
অন্ধকার হয়ে আসছে। আবদুর রহমান সাঁঝের পিদিম দেখাচ্ছে না কেন? ওঃ, ভুলেই গিয়েছিলুম, কেরোসিন ফুরিয়ে গিয়েছে। আর কী-ই বা হবে তেল দিয়ে, জীবনপ্রদীপ যখন–। চুলোয় যাক্গে কবিত্ব।
কিন্তু সামনে একি? প্রকাণ্ড এক ঝুড়ি। তার ভিতরে আটা, রওগন, মটন, আলু, পেঁয়াজ, মুর্গী আরো কত কি? তার সামনে বসে ভুইফোড় কর্নেল; মিটমিটিয়ে হাসছে। ভারী বেয়াদব। আবার আবদুর রহমানের মুখ এত পাঙাশ কেন? আমার ঘুম ভাঙছে না দেখে ভয় পেয়েছে? নাঃ, এ তো ঘুম নয়, স্বপ্নও নয়।
আবদুর রহমান বলল, হুজুর, কাইল সায়েব সওগাত এনেছেন।
একদিনে মানুষ কত উত্তেজনা সইতে পারে?
আবদুর রহমান আবার তাড়াতাড়ি বলল, হুজুর আমাকে দোষ দেবেন না; আমি কিছু বলিনি।
কর্নেল বলল, হুজুর যে কত কষ্ট পেয়েছেন তা আপনার চেহারা থেকেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সবই খুদাতালার মরজি। এখন খুদাতালার মরজিতেই আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল! আপনি যে আমাকে কত স্নেহ করতেন, সেকথা কি আমি ভুলে গিয়েছি।
আমি বললুম, সে কি কথা। তোমাকেই তো আমি সবচেয়ে বেশী বকেছি।
কর্নেল ভারী খুশী। হাঁ, হাঁ, হুজুর সেই কথাই তো হচ্ছে। আপনারও তা হলে মনে আছে। আমাকে সবচেয়ে বেশী স্নেহ না করলে সবচেয়ে বেশী বকলেন কেন? তারপর মৌলানার দিকে তাকিয়ে খুশীতে গদগদ হয়ে বলল, জানেন সায়েব, একদিন মুআল্লিম সায়েব আমার উপর এমনি চটে গেলেন যে, আমাকে বললেন একটা বেত নিয়ে আসতে। ক্লাসের সবাই তাজ্জব হয়ে গেল। আমাদের দেশের মাস্টার বেত আনায় কাপ্তেনকে দিয়ে, না হয় দুষ্ট ছেলের দুশমনকে দিয়ে। সে তখন বেছে বেছে তেজ বেত নিয়ে আসে। আমি তখন কি করলুম জানেন? ভাবলুম, মুআল্লিম সায়েব যখন আর কাউকে কখনো চাবুক মারেননি, তখন তার বউনিতে ফাঁকি দিলে আমার অমঙ্গল হবে। নিয়ে এলুম একখানা পয়লা নম্বরের বেত। তারপর কর্নেল মৌলানার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলল, মুআল্লিম সায়েব তখন কি করলেন, জানেন? বেতখানা হাতে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বেতের কাঁটাগুলো কেটে ফেলিসনি কেন? ছেলেরা সবাই বলল, তাহলে লাগবে কি করে?
মৌলানা বললেন, সেদিন মার খেয়েছিলে বলেই তো আজ কর্নেল হয়েছ।
কর্নেল আপশোষ করে বলল, না, মুআল্লিম সায়েব মারেননি। আমি তো তৈরী ছিলুম। আমার হাতে বেত লাগে না। বলে তার হাত দুখানা মৌলানার সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাল।