আমার থেকে ডাকাতরা যখন প্রায় দশ গজ দূরে তখন তাদের সর্দার হঠাৎ হুকুম দিল দাঁড়া! সঙ্গে সঙ্গে আটজন লোক ডেড হল্ট করলো। দলপতি বলল, নিশান কর। সঙ্গে সঙ্গে আটখানা রাইফেলের গোল ছাদা আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো।
ততক্ষণে আমিও থমকে দাঁড়িয়েছি কিন্তু তারপর কি হয়েছিল আমার আর ঠিক ঠিক মনে নেই।
আমার স্মরণশক্তির ফিল্ম পরে বিস্তর ডেভলাপ করেও তার থেকে এতটুকু আঁচড় বের করতে পারেনি। আমার চৈতন্যের শাটার তখন বিলকুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে মনের সুপার ডবল এক্সও কোনো ছবি তুলতে পারেনি।
আটখানা রাইফেলের অন্ধকোটর আমার দিকে তাকিয়ে আর আমি ঠায় দাঁড়িয়ে, এ দৃশ্যটা আমি তারপর বারকয়েক স্বপ্নেও দেখছি কাজেই আজ আর হলপ করে বলতে পারব না কোন ঘটনা কোন্ চিন্তাটা সত্যি বাবুর শাহ গ্রামের কাছে বাস্তবে ঘটেছিল আর কোনটা স্বপ্নের কল্পনা মাত্র।
আবছা আবছা শুধু একটি কথা মনে পড়ছে, কিন্তু আবার বলছি হলপ করতে পারব না।
আমার ডান হাত ছিল ওভারকোটের পকেটে ও তাতে ছিল আবদুর রহমানের গুঁজে দেওয়া ছোট্ট পিস্তলটি। একবার বোধ করি লোভ হয়েছিল সেই পিস্তল বের করে অন্ততঃ এক ব্যাটা বদমাইশকে খুন করার। মনে হয়েছিল, মরব যখন নিশ্চয়ই তখন স্বর্গে যাবার পুণ্যটাও জীবনের শেষ মুহূর্তে সঞ্চয় করে নিই।
আজ আমার আর দুঃখের সীমা নেই, কেন সেদিন গুলী করলুম না।
পাগলা বাদশা মুহম্মদ তুগলুক তার প্রজাদের ব্যবহারে, এবং প্রজারা তাঁর ব্যবহারে এতই তিতবিরক্ত হয়ে উঠেছিল যে, তিনি যখন মারা গেলেন তখন তুগলুকের সহচর ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বরনী বলেছিলেন, মৃত্যুর ভিতর দিয়ে বাদশা তার প্রজাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলেন, প্রজারা বাদশার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল।
সেদিন পুণ্যসঞ্চয়ের লোভে যদি গুলী চালাতুম তা হলে সংসারের পাঁচজন আমার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতেন, আমিও তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতুম।
হঠাৎ শুনি অট্টহাস্য। তরসীদ, তরসীদ, সবাই চেঁচিয়ে বলেছে, তরসীদ–অর্থাৎ ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে, লোকটা ভয় পেয়েছে রে। আর সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে কুটিকুটি। কেউ মোটা গলায় খক্ খক্ করে, কেউ বন্দুকটা বগলদাবায় চেপে খ্যাক খ্যাক করে, কেউ ড্রইংরুমবিহারিণীদের মত দুহাত তুলে কলরব করে, আর দু-একজন আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মিটমিটিয়ে।
একজন হেঁড়ে গলায় বলল, এই মুরগীটাকে মারার জন্য আটটা বুলেটের বাজে খর্চা। ইয়া আল্লা।
আমার দৈর্ঘ্যপ্রস্থের বর্ণনা দেব না, কারণ গড়পড়তা বাঙালীকে মুরগী বলার হক এদের আছে।
মুরগী হই আর মোরগই হই আমি কসাইয়ের হাত থেকে খালাস পাওয়া মুরগীর মত পালাতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু পেটের ভিতর কি রকম একটা অদ্ভুত ব্যথা আরম্ভ হয়ে যাওয়াতে অতি আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে চলতে আরম্ভ করলুম।
আফগান রসিকতা হাস্যরস না রুদ্ররসের পর্যায়ে পড়ে সে বিচার আলঙ্কারিকেরা করবেন। আমার মনে হয় রসটা বীভৎসতা-প্রধান বলে মহামাংসের ওজনে এটাকে মহারস বলা যেতে পারে।
কিন্তু এই আমার শেষ পরীক্ষা নয়।
বাড়ি থেকে ফালংখানেক দূরে আরেকদল ডাকাতের সঙ্গে দেখা; কিন্তু এদের সঙ্গে নূতন ঝকমকে য়ুনিফর্ম-পরা একটি ছোকরা অফিসার ছিল বলে বিশেষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলুম না। দলটা যখন কাছে এসেছে, তখন অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে যেন চেনা চেনা বলে মনে হল। আরে! এ-তো দু দিন আগেও আমার ছাত্র ছিল। আর পড়াশোনায় এতই ডডনং এবং আকাটমুখ ছিল যে, তাকেই আমি আমার মাস্টারি জীবনে বকাঝকা করেছি সবচেয়ে বেশী।
সেই কথাটা মনে হতেই আমি আবার আটটা রাইফেলের চোঙা চোখের সামনে দেখতে পেলুম। ডাইনে গলি ছিল; বেয়াড়া ঘুড়ির মত গোত্তা খেয়ে সেদিকে টু দিলুম। ছেলেটা যদি দাদ তোলার তালে থাকে, তবে অক্কা না হোক কপালে বেইজ্জতি তো নিশ্চয়ই। হে মুরশিদ, কি কুক্ষণেই না এই দুশমনের পুরীতে এসেছিলুম। হে মৌলা আলীর মেহেরবান, আমি জোড়া বকরী–
পিছনে শুনি মিলিটারি বুটের ছুটে আসার শব্দ। তবেই হয়েছে। মুরশিদ, মৌলা সকলেই আমাকে ত্যাগ করেছেন। ইংরিজী প্রবাদেরই তবে আশ্রয় নিই–ইভন দি ওয়ার্ম টানস। ঘুরে দাঁড়ালুম। ছেলেটা চেঁচাচ্ছে মুআল্লিম সায়েব, মুআল্লিম সায়েব। কাছে এসে আবদুর রহমানী কায়দায় সে আমার হাত দুখানা তুলে ধরে বার বার চুমো খেল, কুশল জিজ্ঞেস করল এবং শেষটায় বেমক্কা ঘোরাঘুরির জন্য মুরুব্বির মত ঈষৎ তন্বীও করল। আমি–হেঁ হেঁ, বিলক্ষণ, বিলক্ষণ, তা আর বলতে, অহমদুলিল্লা, অহহলিল্লা, তওবা তওবা বলে গেলুম কখনো তাগ-মাফিক ঠিক জায়গায়, কখনো ভয়ের ধকল কাটাতে গিয়ে উল্টো-পাল্টা।
ফাঁড়া কেটে যাওয়ায়, আমারও সাহস বেড়ে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করলুম, এ বেশ কোথায় পেলে, বৎস?
বাবুর-শাহ পাহাড়ের মত বুক উঁচু করে বৎস বলল, কাইল শুদম অর্থাৎ আমি কর্নেল হয়ে গিয়েছি।
ইয়া আল্লা। উনিশ বছর বয়সে রাতারাতি কর্নেল। আমাদের সুরেশ বিশ্বাস চেনার মধ্যে তো উনিই আমাদের নীলমণি–তো এত বড় কসরৎ দেখাতে পারেননি। আমার লোভ বেড়ে গেল। শুধালুম, জেনরাইল হবার দিল্লী কতদূর?
গম্ভীরভাবে বললে, দূর নীস্ত্।
খুদাতালা মেহেরবান, বিপ্লবটা বড়ই পয়মন্ত।
কর্নেল সায়েব বুঝিয়ে বললেন, আমীর হবীব উল্লা খান আমার পিসির দেবরের মামাশ্বশুর।।
সম্পর্কটা ঠিক কি বলেছিল, আমার মনে নেই, তবে এর চেয়ে ঘনিষ্ঠ নয়। আমি অত্যন্ত গর্ব করলুম; ধন্য আমার মাস্টারি, ধন্য আমার শিষ্য, ধন্য এ বিপ্লব, ধন্য এ উপবাস। আমার শিষ্য রাতারাতি কর্নেল হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই অবস্থায়ই গেয়েছিলেন–