বহুমূল্য আভরণে করিয়ো না সুসজ্জিত
কবর আমার।
তৃণশ্রেষ্ঠ আভরণ দীনা আত্মা জাহান-আরা
সম্রাট কন্যার।*
বলে পাঁচজনকে সাবধান করে দেবার প্রয়োজনও বোধ করেননি। তবে একথা ঠিক, তিনি তাঁর শেষ শয্যা যেমন কর্মভূমি ভারতবর্ষে গ্রহণ করতে চাননি ঠিক তেমনি জন্মভূমি ফরগনাকেও মৃত্যুকালে স্মরণ করেননি।
যীশুখ্রষ্ট বলেছেন–
The foxes have boles and the birds of the air have nests; but the Son of man hath not where to lay his head.
রবীন্দ্রনাথও বলেছেন–
বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে
কে মোর আত্মপর?
আমার বিধাতা আমাতে জাগিলে
কোথায় আমার ঘর?
জীবিতাবস্থায়ই যখন মহাপুরুষের আশ্রয়স্থল নেই তখন মৃত্যুর পর তার জন্মভূমিই বা কি আর মৃত্যুস্থলই বা কি?
ইংরিজী সার্ভে কথাটা গুজরাতীতে অনুবাদ করা হয় সিংহাবলোকন দিয়ে। বাবুর শব্দের অর্থ সিংহ। আমার মনে হল এই উঁচু পাহাড়ের উপর বাবুরের গোর দেওয়া সার্থক হয়েছে। এখান থেকে সমস্ত কাবুল উপত্যকা, পূর্বে ভারতমুখী গিরিশ্রেণী, উত্তরে ফরগনা যাবার পথে হিন্দুকুশ, সব কিছু ডাইনোঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সিংহাবলোকনে দেখছেন সিংহরাজ বাবুর।
নেপোলিয়নের সমাধি-আস্তরণ নির্মাণ করা হয়েছে মাটিতে গর্ত করে সমতলভূমির বেশ খানিকটা নিচে। স্থপতিকে এরকম পরিকল্পনা করার অর্থ বোঝাতে অনুরোধ করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, যে-সম্রাটের জীবিতাবস্থায় তার সামনে এসে দাঁড়ালে সকলকেই মাথা হেঁট করতে হত, মৃত্যুর পরও তার সামনে এলে সব জাতিকে যেন মাথা নিচু করে তার শেষ-শয্যা দেখতে হয়।
ফরগনার গিরিশিখরে দাঁড়িয়ে যে-বাবুর সিংহাবলোকন দিয়ে জীবনযাত্রা আরম্ভ করেছিলেন, যে-সিংহাবলোকনদক্ষতা বাবুরের শিরে হিন্দুস্থানের রাজমুকুট পরিয়েছিল সেই বাবুর মৃত্যুর পরও কি সিংহাবলোকন করতে চেয়েছিলেন?
জীবনমরণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাই কি বাবুর কাবুলের গিরিশিখরে দেহাস্থি রক্ষা করার শেষ আদেশ দিয়েছিলেন?
কিন্তু কি পরস্পরবিরোধী প্রলাপ বকছি আমি? একবার বলছি বাবুর তার শেষশয্যা সম্বন্ধে সম্পুর্ণ উদাসীন ছিলেন আর তার পরক্ষণেই ভাবছি মৃত্যুর পরও তিনি তার বিহারস্থলের সম্মােহন কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তবে কি মানুষের চিন্তা করার কল মগজে নয়, সেটা কি পেটে? না-খেতে পেয়ে সে যন্ত্র স্টিয়ারিঙ ভাঙা মোটরের মত চতুর্দিকে এলোপাতাড়ি ছুটোছুটি লাগিয়েছে?
পিছন ফিরে শেষ বারের মত কবরের দিকে তাকাতে আমার মনের সব দ্বন্দ্বের অবসান হল। বরফের শুভ্র কম্বলে ঢাকা ফকীর বাবুর খোদাতালার সামনে সজদা (ভূমিষ্ট প্রণাম) নিয়ে যেন অন্তরের শেষ কামনা জানাচ্ছেন। কি সে কামনা?
ইংরেজ-ধর্ষিত ভারতের জন্য মুক্তি-মোক্ষ-নজাত কামনা করছেন। শিবাজী-উৎসবে গুরুদেব গেয়েছিলেন,
মৃত্যু সিংহাসনে আজি বসিয়াছ অমরমুরতি
সমুন্নত ভালে
যে রাজকীরিট শোভে লুকাবে না তার দিব্যজ্যোতি
কভু কোনোকালে।
তোমারে চিনেছি আজি চিনেছি চিনেছি হে রাজন
তুমি মহারাজ
তব রাজকর লয়ে আটকোটি বঙ্গের নন্দন
দাঁড়াইবে আজ।।
প্রথম সেটি আবৃত্তি করলুম; তারপর কুরানশরীফের আয়াত পড়ে, পরলোকগত আত্মার সদ্গতির জন্য মোনাজাত করে পাহাড় থেকে নেমে নিচে বাবুর-শাহ গ্রামে এলুম।
শুনেছি মানস-সরোবর যাবার পথে নাকি তীর্থযাত্রীরা অসহ্য কষ্ট সত্ত্বেও মরে না, মরে ফেরার পথে–শীত, বরফ, পাহাড়ের চড়াই-ওৎড়াই সহ্য হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। তখন নাকি তাদের সম্মুখে আর কোনো কাম্যবস্তু থাকে না বলে মনের জোর একদম লোপ পেয়ে যায়। ফিরে তো যেতে হবে সেই আপন বাসভূমে, দৈনন্দিন দুঃখযন্ত্রণা, আশানিরাশার একটানা জীবন স্রোতে। এ-বিরাট অভিজ্ঞতার পর সে-পতন এতই ভয়াবহ বলে মনে হয় যে, তখন সামান্যতম সঙ্কটের সামনে তীর্থযাত্রী ভেঙে পড়ে আর বরফের বিছানায় সেই যে শুয়ে পড়ে তার থেকে আর কখনো ওঠে না।
আমার পা আর চলে না। কোমর ভেঙ্গে পড়ছে। মাথা ঘুরছে।
শীতে হাতপায়ের আঙ্গুলের ডগা জমে আসছে। কান আর নাক অনেকক্ষণ হল সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে গিয়েছে। জোরে হেঁটে যে গা গরম করব সে শক্তি আমার শরীরে আর নেই।
নির্জন রাস্তা। হঠাৎ মোড় ঘুরতেই সামনে দেখি উল্টো দিক থেকে আসছে গোটাআষ্টেক উদীপরা সেপাই। ভালো করে না তাকিয়েই বুঝতে পারলুম, এরা বাচ্চায়ে সকাওয়ের দলের ডাকাত–আমান উল্লার পলাতক সৈন্যদের ফেলে-দেওয়া উদী পরে নয়া শাহানশাহ বাদশার ভুইফোড় ফৌজের গণ্যমান্য সদস্য হয়েছেন। পিঠে চকচকে রাইফেল ঝোলানো, কোমরে বুলেটের বেল্ট আর চোখে মুখে যে ক্রুর, লোলুপ ভাব তার সঙ্গে তুলনা দিতে পারি এমন চেহারা আমি জেলের বাইরে ভিতরে কোথাও দেখিনি। জীবনের বেশীর ভাগ এরা কাটিয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে, হয় গোরস্তানে নয় পর্বতগুহার আধা-আলো-অন্ধকারে। পুঞ্জীভূত আশু পুরীষপকে শূকর উল্টেপাল্টে দিলে যে বীভৎস দুর্গন্ধ বেয়োয় রাষ্ট্রবিপ্লবে উৎক্ষিপ্ত এই দস্যুদল আমার সামনে সেই রূপ সেই গন্ধ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল।
ডাকাতগুলোর গায়ে ওভারকোট নেই। সেই লোভেতেই তো তারা আমাকে খুন করতে পারে। নির্জন রাস্তায় নিরীহ পথিককে খুন করে তার সব কিছু লুটে নেওয়া তো এদের কাছে কোনো নূতন পুণ্যসঞ্চয় নয়।
আমার পালাবার শক্তি নেই, পথও নেই। তার উপরে আমি গাঁয়ের ছেলে। বাঘ দেখলে পালাই, কিন্তু বুনো শুয়োরের সামনে থেকে পালাতে কেমন যেন ঘেন্না বোধ হয়। পালাই অবশ্য দুই অবস্থাতেই।