জোর গরম পড়েছে বেলা দুটো। শহরে চর্কিবাজীর মত ঘুরতে হয়েছে দেদার সাবান চোখে পড়েছে কিন্তু কিনিনি ভদ্রলোকের ছেলেকে পেট্রনাইজ করতে হবে।
ট্রাম থেকে নেমে দোকানের সামনে এসে দেখি ভদ্রলোক নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছেন, পাখিটা খাঁচায় ঘুমচ্ছে, ঘড়িটা পর্যন্ত সেই যে বারোটায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, এখনো জাগেনি।
আমি মোলায়েম সুরে বললুম, ও মশাই, মশাই। ফের ডাকলুম, ও সায়েব, সায়েব।
কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেজায় গরম, আমারও মেজাজ একটু একটু উষ্ণ হতে আরম্ভ করেছে। এবার চেঁচিয়ে বললুম, ও মশাই, ও সায়েব।
ভদ্রলোক আস্তে আস্তে বোয়াল মাছের মত দুই রাঙা টকটকে চোখ সিকিটাক খুলে বললেন, আজ্ঞে? তারপর ফের চোখ বন্ধ করলেন।
আমি বললুম, সাবান আছে? পামওলিভ সাবান?
চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিলেন, না।
আমি বললুম, সে কি কথা, ঐ তো রয়েছে শো-কেসে।
ও বিকিরির না।–
তারপর আহমদ আলীকে জিজ্ঞাসা করলুম, পাঠানরাও বুঝি এই রকম ব্যবসা করে? তিনি তো খুব খানিকক্ষণ ধরে হাসলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কেন বলুন তো?
আমি উত্তর দিলুম, ঐ যে বললেন এসব বাস কাবুল যায় না।
এবার আহমদ আলী থমকে দাঁড়ালেন। দেয়ালের দিকে ঘুরে, কোমরে দুহাত দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঠাঠা করে হাসলেন। সে তো হাসি নয়–হাসির ধমক। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি কখন তার হাসি থামবে। উত্তর দিলেন ভালো। বললেন, এসব বাস খাইবারপাস অবধি গিয়েই ব্যস!
আমি শুধালুম, এই সামান্য রসিকতায় আপনি এত প্রচুর হাসতে পারেন কি করে?
কেন পারব না? হাসি কি আর গল্পে ঠাসা থাকে, হাসি থাকে খুশ-দিলে। আপনাকে বলিনি স্বাধীনতা কোথায় বাসা বেঁধে থাকে? রাইফেলে নয়, বুকের খুনে। একটা গল্প শুনবেন? ঐ দেখছেন, হোথায় চায়ের দোকানী বটতলায় বেঞ্চি পেতে দিয়েছে। চলুন না।
পাঠান মাত্রই মারাত্মক ডিমোক্র্যাট। নির্জলা টাঙাওয়ালা বিড়িওয়ালার চায়ের দোকান।
আহমদ আলী তার বিশাল বপুখানার ওজন সম্বন্ধে সচেতন বলে খুটির উপর ভর দিয়ে বসলেন, আমি আমার তনুখানা যেখানে খুশী রাখলুম। বললেন–
ওমর খৈয়ামের এক রাত্রে বড্ড নেশা পেয়েছে কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন পাঁচখানা রুবাইয়াৎ শেষ না করে উঠবেন না। জানেন তো কি রকম ঠাসবুনুনির কবিতা শেষ করতে করতে রাত প্রায় কাবার হয়ে এল। মদের দোকানে যখন পৌঁছলেন তখন ভোর হব হব। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, নিয়ে এস তো হে, এক পাত্তর উৎকৃষ্ট শিরাজী! মদওয়ালা কাচুমাচু হয়ে বলল হুজুর এত দেরীতে এসেছেন, রাত কাবারের সঙ্গে সঙ্গে মদও কাবার হয়ে গিয়েছে। ওমর নরম হয়ে বললেন, শিরাজী নেই তো অন্য কোনো মাল দাও না। মদওয়ালা বলল, শরম কী বাৎ। কিছু নেই হুজুর। ওমর বললেন, পরোয়া নদারদ, ঐ যে সব এটো পেয়ালাগুলো গড়াগড়ি যাচ্ছে সেগুলো ধুয়ে তাই দাও দিকিনি–নেশার জিম্মাদারি আমার।
হিম্মতের জিম্মাদারি, হাসির জিম্মাদারি, নেশার জিম্মাদারি কিসে, কার, সে সম্বন্ধে আলোচনা করার পূর্বেই দেখতে পেলুম রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন সেই ভেজাল পাঠান তার ব্রাত্য-দোষ, তিনি তিন মাস লাহোরে কাটিয়েছিলেন–রমজান খান। আমি আহমদ আলীকে আঙুল দিয়ে দেখালুম। আর যায় কোথায়? ও রমজান খান, জানে মন্, বরাদরে মন্, এদিকে এসো। আমাকে তম্বী করে বললেন, আশ্চর্য লোক, আমি না ডাকলে আপনি এঁকে যেতে দিতেন? এই গরমে? লোকটা সর্দিগমি হয়ে মারা যেত না? আল্লা রসুলের ডর-ভয় নেই?
রমজান খান এসে বললেন, ভগিনীপতির অসুখ, তার করতে যাচ্ছি। বলেই ঝুপ করে বেঞ্চিতে বসে পড়লেন। আহমদ আলী সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, হবে, হবে, সব হবে। টেলিগ্রাফের তার শক্ত মালে তৈরী দুচার ঘণ্টায় ক্ষয়ে যাবে না। সুখবর শোনন। সৈয়দ সাহেব একখানা বহুৎ উন্দা গল্প পেশ করেছেন। বলে তিনি আমার কাঁচাসিদ্ধ গল্পে বিস্তর টমাটো-রস আর উস্টার সস ঢেলে রমজান খানকে পরিবেশন করলেন। বারে বারে বলেন ও সাবান বিকিরির না–এ বাস কাবুল যায় না। এ যেন বাঙলা দেশের পুব আকাশে সূর্যোদয় আর পেশাওয়ারের পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে গেল। হুবহু একই রঙ।
রমজান খান বললেন, তা তো বুঝলুম। কিন্তু বাঙালী আর পাঠানে একটা জায়গায় সৎ গরমিল আছে।
আমি শুধালুম, কিসে?
রমজান খান বললেন, আমি সিন্ধুনদ পেরিয়ে আহমদ আলীর পাক নজরে যে মহাপাপ করেছি এটা সেই সিন্ধুপারের কাহিনী। তবে আটকের কাছে নয়, অনেক দক্ষিণে সেখানে সিন্ধু বেশ চওড়া। তারি বালুচরে বসে দুপুর নোদে আটজন পাঠান ঘামছে। উট ভাড়া দিয়ে তারা ছিয়ানব্বই টাকা পেয়েছে, কিন্তু কিছুতেই সমানেসমান ভাগ বাটোয়ারা করতে পারছে না। কখনো কারো হিস্যায় কম পড়ে যায়, কখনো কিছু টাকা উপরি থেকে যায়। ক্রমাগত নূতন করে ভাগ হচ্ছে, হিসেব মিলছে না, ঘাম ঝরছে আর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গলাও চড়ছে। এমন সময় তারা দেখতে পেল, অন্য পার দিয়ে এক বেনে তার পুঁটুলি হাতে করে যাচ্ছে। সব পাঠান এক সঙ্গে চেঁচিয়ে বেনেকে ডাকল, এপারে এসে তাদের টাকার ফৈালা করে দিয়ে যেতে। বেনে হাত-পা নেড়ে বোঝালো অত মেহন্নত তার সইবে না, আর কত টাকা কজন লোক তাই জানতে চাইল। চার কুড়ি দশ ও তার উপরে ছয় টাকা আর হিস্যেদার আটজন। বেনে বলল, বারো টাকা করে নাও। পাঠানরা চেঁচিয়ে বলল, তুই একটু সবুর কর, আমরা দেখে নিচ্ছি বখরা ঠিক ঠিক মেলে কি না। মিলে গেল সবাই অবাক। তখন তাদের সর্দার চোখ পাকিয়ে বলল, এতক্ষণ ধরে আমরা চেষ্টা করলুম, হিসেব মিলল না; এখন মিলল কি করে? ব্যাটা নিশ্চয়ই কিছু টাকা সরিয়ে নিয়ে হিসেব মিলিয়ে দিয়েছে। ওপার থেকে সে যখন হিসেব মেলাতে পারে তখন নিশ্চয়ই কিছু টাকা সরাতেও পারে। পাকড়ো শালাকো।