অন্য সময় হলে হয়ত এই খেই ধরে জর্মনিতে রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধের মালমশলা যোগাড় করে নিতুম, কিন্তু আমার দেহ তখন বাড়ি ফিরে খাটে শোবার জন্য আঁকুবাঁকু লাগিয়েছে।
উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, এ দুর্দিনে যে আপনি নিজের থেকে আমার অনুসন্ধান করেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দেবার মত ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছিনে। বৃত্তি হলে ভালো, না হলেও আমি সয়ে নিতে পারব। কিন্তু আপনার সৌজন্যের কথা কখন ভুলতে পারব না।
রাজদূতও উঠে দাঁড়ালেন। শেকহ্যাণ্ডের সময় হাতে সহৃদয়তার চাপ দিয়ে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই বৃত্তিটা পাবেন। নিশ্চিন্ত থাকুন।
দূতাবাস থেকে বেরিয়ে বাড়িটার দিকে আরেকবার ভালো করে তাকালুম। সমস্ত বাড়িটা আমার কাছে যেন মধুময় বলে মনে হল। তীর্থের উৎপত্তি কি করে হয় সে-সম্বন্ধে আমি কখনো কোনো গবেষণা করিনি; আজ মনে হল, সহৃদয়তা, করুণা মৈত্রীর সন্ধান যখন এক মানুষ অন্য মানুষের ভিতর পায় তখন তাঁকে কখনো মহাপুরুষ কখনো অবতার কখনো দেবতা বলে ডাকে এবং তাঁর পাদপীঠকে জড় জেনেও পূণ্যতীর্থ নাম দিয়ে অজরামর করে তুলতে চায়। এবং সে-বিচারের সময় মানুষ উপকারের মাত্রা দিয়ে কে মহাপুরুষ কে দেবতা সে-কথা যাচাই করে না, তার স্পর্শকাতর হৃদয় তখন কৃতজ্ঞতার বন্যায় সব তর্ক সব যুক্তি সব পরিপ্রেক্ষিত, সব পরিমাণজ্ঞান ভাসিয়ে দেয়।
শুধু একটি পরিমাণজ্ঞান আমার মন থেকে তখনো ভেসে যায়নি এবং কস্মিন কালেও যাবে না–
যে ভদ্রলোক আমাকে এই দুর্দিনে স্মরণ করলেন তিনি রাজদূত, স্যার ফ্রান্সিস হামফ্রিসও রাজদূত।
কিন্তু আর না। ভাবপ্রবণ বাঙালী একবার অনুভূতিগত বিষয়বস্তুর সন্ধান পেলে মূল বক্তব্য বেবাক ভুলে যায়।
তিতিক্ষু পাঠক, এস্থলে আমি করজোড়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। জর্মন রাজদূতের সঙ্গে আমার যোগাযোগের কাহিনীটা নিতান্ত ব্যক্তিগত এবং তার বয়ান ভ্রমণ-কাহিনীতে চাপানো যুক্তিযুক্ত কি না সে-বিষয়ে আমার মনে বড় দ্বিধা রয়ে গিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার যে হিরণয় পাত্রে সত্যস্বরূপ রস লুক্কায়িত আছেন তার ব্যক্তি-হিরণ আপন চাকচিক্য দিয়ে আমার চোখ এমনি ধাঁধিয়ে দিয়েছে যে, তাই দেখে আমি মুগ্ধ, সে-পূষণ কোথায় যিনি পাত্রখানি উন্মোচন করে আমার সামনে নৈর্ব্যক্তিক, আনন্দঘন, চিরন্তন রসসত্তা তুলে ধরবেন?
বিপ্লবের একাদশী, ইংরেজ রাজদূতের বিদগ্ধ বর্বরতা, জর্মন রাজদূতের অযাচিত অনুগ্রহ অনাত্মীয় বৈরাগ্যে নিরীক্ষণ করা তো আমার কর্ম নয়।
জর্মন রাজদূতাবাস থেকে বেরিয়ে মনে পড়লো, বারো বৎসর পূর্বে আফগানিস্থান যখন পরাধীন ছিল তখন আমীর হাবীব উল্লা রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপকে এই বাড়িতে রেখে অতিথিসৎকার করেছিলেন। এই বাড়ির পাশেই হিন্দুস্থানের সম্রাট বাবুর বাদশার কবর। সে-কবর দেখতে আমি বহুবার গিয়েছি, আজ যাবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু কেন জানিনে, পা দুখানা আমাকে সেই দিকেই টেনে নিয়ে গেল।
খোলা আকাশের নিচে কয়েকফালি পাথর দিয়ে বানানো অত্যন্ত সাদাসিদে কবর। মোগল সরকারের নগণ্যতম মুহুরিরের কবরও হিন্দুস্থানে এর চেয়ে বেশী জৌলুশ ধরে। এ কবরের তুলনায় পুত্র হুমায়ুনের কবর তাজমহলের বাড়া। আর আকবর জাহাঙ্গীর যেসব স্থাপত্য রেখে গিয়েছেন সে সব তো বাবুরের স্বপ্নও ছাড়িয়ে যায়।
বাবুরের আত্মজীবনী যাঁরা পড়েছেন তারা এই কবরের পাশে দাঁড়ালে যে অনুভূতি পাবেন সে-অনুভূতি হুমায়ুন বা শাহজাহানের কবরের কাছে পাবেন না। বাবুর মোগলবংশের পত্তন করে গিয়েছেন এবং আরো বহু বহু বীর বহু বহু বংশের পত্তন করে গিয়েছেন কিন্তু বাবুরের মত সুসাহিত্যিক রাজা-রাজড়াদের ভিতর তো নেই-ই সাধারণ লোকের মধ্যেও কম। এবং সাহিত্যিক হিসেবে বাবুর ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ মাটির মানুষ এবং সেই তত্ত্বটি তাঁর আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় বার বার ধরা পড়ে। কবরের কাছে দাঁড়িয়ে মনে হয় আমি আমারই মত মাটির মানুষ, যেন এক আত্মজনের সমাধির কাছে এসে দাঁড়িয়েছি।
আমাদের দেশের একজন ঐতিহাসিক সীজারের আত্মজীবনীর সঙ্গে বাবুরের আত্মজীবনীর তুলনা করতে গিয়ে প্রথমটির প্রশংসা করেছেন বেশী। তার মতে বাবুরের আত্মজীবনী এশ্রেণীর লেখাতে দ্বিতীয় স্থান পায়। আমি ভিন্ন মত পোষণ করি। কিন্তু এখানে সে তর্ক জুড়ে পাঠককে আর হয়রান করতে চাইনে। আমার বক্তব্য শুধু এইটুকু : দুটি আত্মজীবনীই সাহিত্যসৃষ্টি, নীরস ইতিহাস নয়। এর মধ্যে ভালো মন্দ বিচার করতে হলে ঐতিহাসিক হবার কোন প্রয়োজন নেই। যে-কোনো রসজ্ঞ পাঠক নিজের মুখেই ঝাল খেয়ে নিতে পারবেন। তবে আপশোস শুধু এইটুকু, বাবুর তাঁর কেতাব জগতাই তুর্কীতে ও সীজার লাতিনে লিখেছেন বলে বই দুখানি মূলে পড়া আমাদের পক্ষে সোজা নয়। সানা এইটুকু যে, আমাদের লব্ধপ্রতিষ্ঠ ঐতিহাসিকও কেতাব দুখানা অনুবাদে পড়েছেন।
পূর্বেই বলেছি কবরটি অত্যন্ত সাদামাটা এবং এতই অলঙ্কারবর্জিত যে, তার বর্ণনা দিতে পারেন শুধু জবরদস্ত আলঙ্কারিকই। কারণ, বাবুর তাঁর দেহাস্থি কিভাবে রাখা হবে সে সম্বন্ধে এতই উদাসীন ছিলেন যে, নূর-ই-জহানের মত।
গরীব-গোরে দীপ জ্বেল না ফুল দিও না
কেউ ভুলে–
শামা পোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায়
বুলবুলে।
(সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)
কবিত্ব করেন নি, বা জাহান-আরার মত–