ইতিমধ্যে ফরাসী, জর্মন প্রভৃতি বিদেশী পুরুষেরা ভারতীয় প্লেনে কাবুল ত্যাগ করেছেন স্ত্রীলোকেরা তো আগেই চলে গিয়েছিলেন। শেষটায় শুনলুম ভারতীয় পুরুষদের কেউ কেউ স্যার ফ্রান্সিসের ফেবারে স্বদেশে চলে যেতে পেরেছেন। আমার নামে তো ঢ্যারা, কাজেই মৌলানাকে বললুম, তিনি যদি প্লেনে চাপবার মোকা পান তবে যেন পিছন পানে না তাকিয়ে যুধিষ্ঠিরের মত সোজা পিতৃলোক চলে যান। অনুজ যদি অনুগ হবার সুবিধে না পায় তবে তার জন্য অপেক্ষা করলে ফল পিতৃলোকে প্রত্যাগমন না হয়ে পিতৃলোকে মহাপ্রয়াণই হবে। চাণক্য বলেছেন, উৎসবে, ব্যসনে এবং রাষ্ট্র বিপ্লবে যে কাছে দাঁড়ায় সে বান্ধব। এস্থলে সে-নীতি প্রযোজ্য নয়, কারণ, চাণক্য স্বদেশে রাষ্ট্রবিপ্লবের কথাই ভাবছিলেন, বিদেশের চক্রব্যুহের খাঁচায় ইঁদুরের মত না খেয়ে মরবার উপদেশ দেননি।
অল্প অল্প জ্বরের অবচেতন অবস্থায় দেখি দরজা দিয়ে উর্দিপরা এক বিরাট মূর্তি ঘরে ঢুকছে। দুর্বল শরীর, মনও দুর্বল হয়ে গিয়েছে। ভাবলুম, বাচ্চায়ে সকাওয়ের জল্লাদই হবে; আমার সন্ধানে এখন আর আসবে কে?
নাঃ। জর্মন রাজদূতাবাসের পিয়ন। কিন্তু আমার কাছে কেন? ওদের সঙ্গে তো আমার কোনো দহরমমহরম নেই। জর্মন রাজদূত আমাকে এই দুর্দিনে নিমন্ত্রণই বা করবেন কেন? আবার পইপই করে লিখেছেন, বড্ড জরুরী এবং পত্রপাঠ যেন আসি।
দুমাইল বরফ ভেঙে জর্মন রাজদূতাবাস। যাই কি করে, আর গিয়ে হবেই বা কি? কোনো ক্ষতি যে হতে পারে না সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত, কারণ আমি বসে আছি সিঁড়ির শেষ ধাপে, আমাকে লাথি মারলেও এর নিচে আমি নামতে পারি না।।
শেষটায় মৌলানার ধাক্কাধাক্কিতে রওয়ানা হলুম।
জর্মন রাজদূতাবাস যাবার পথ সুদিনে অভিসারিকাদের পক্ষে বড়ই প্রশস্ত নির্জন, এবং বনবীথিকার ঘনপল্লবে মর্মরিত। রাস্তার একপাশ দিয়ে কাবুল নদী একেবেঁকে চলে গিয়েছেন; তারই রসে সিক্ত হয়ে হেথায় নব-কুঞ্জ, হোথায় পঞ্চ-চিনার। নিতান্ত অরসিকজনও কল্পনা করে নিতে পারে যে লুকোচুরি রসকেলির জন্য এর চেয়ে উত্তম বন্দোবস্ত মানুষ চেষ্টা করেও করতে পারত না।
কিন্তু এ-দুর্দিনে সে-রাস্তা চোরডাকাতের বেহেশৎ, পদাতিকের গোরস্তান।
আবদুর রহমান বেরবার সময় ছোট পিস্তলটা জোর করে ওভারকোটের পকেটে পুরে দিয়েছিল। নিতান্ত ফিচেল চোর হলে এটা কাজে লেগে যেতেও পারে।
এসব রাস্তায় হাঁটতে হয় সগর্বে, সদম্ভে ডাইনে বাঁয়ে না তাকিয়ে, মাথা খাড়া করে। কিন্তু আমার সে তাগদ কোথায়? তাই শিষ দিয়ে দিয়ে চললুম এমনি কায়দায় যেন আমি নিত্যিনিত্যি এ-পথ দিয়ে যাওয়া আসা করি।
পথের শেষে পাহাড়। বেশ উঁচুতে রাজদূতাবাস। সে-চড়াই ভেঙে যখন শেষটায় রাজদূতের ঘরে গিয়ে ঢুকলুম তখন আমি ভিজে ন্যাকড়ার মত নেতিয়ে পড়েছি। রাজদূত মুখের কাছে ব্র্যাণ্ডির গেলাশ ধরলেন। এত দুঃখেও আমার হাসি পেল, মুসলমান মরার পূর্বে মদ খাওয়া ছাড়ে, আমি মরার আগে মদ ধরব নাকি? মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালুম।
জর্মনরা কাজের লোক। ভণিতা না করেই বললেন, বেনওয়া সায়েবের মুখে শোনা, আপনি নাকি জর্মনিতে পড়তে যাবার জন্য টাকা কামাতে এদেশে এসেছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনার সব টাকা নাকি এক ভারতীয় মহাজনের কাছে জমা ছিল, এবং সে নাকি বিপ্লবে মারা যাওয়ায় আপনার সব টাকা খোয়া গিয়েছে?
আমি বললুম, হ্যাঁ।
রাজদূত খানিকক্ষণ ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বিশেষ করে কেন জর্মনিতেই যেতে চেয়েছিলেন, বলুন তো।
আমি বললুম, শান্তিনিকেতন লাইব্রেরীতে কাজ করে ও বিশ্বভারতীর বিদেশী পণ্ডিতদের সংসর্গে এসে আমার বিশ্বাস হয়েছে যে, উচ্চশিক্ষার জন্য আমার পক্ষে জর্মনিই সব চেয়ে ভালো হবে।
এ ছাড়া আরো একটা কারণ ছিল, সেটা বললুম না।
রাজদূতেরা কখন খুশী কখন বেজার হয় সেটা বোঝা গেলে নাকি তাঁদের চাকরী যায়। কাজেই আমি তার প্রশ্নের কারণের তাল ধরতে না পেরে, বায়াতবলা কোলে নিয়ে বসে রইলুম।
বললেন, আপনি ভাববেন না এই কটি খবর সঠিক জানবার জন্যই আপনাকে কষ্ট দিয়ে এখানে আনিয়েছি। আমি শুধু আপনাকে জানাতে চাই, আমাদ্বারা যদি আপনার জর্মনি যাওয়ার কোনো সুবিধা হয় তবে আমি আপনাকে সে সাহায্য আনন্দের সঙ্গে করতে প্রস্তুত। আপনি বলুন, আমি কি প্রকারে আপনার সাহায্য করতে পারি?
আমি অনেক ধন্যবাদ জানালুম। রাজদূত উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছেন, কিন্তু আমার চোখে কোনো পন্থাই ধরা দিচ্ছে না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল— খোদা আছেন, গুরু আছেন— বললুম, জর্মন সরকার প্রতি বৎসর দু-একটি ভারতীয়কে জর্মনিতে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি দেন। তারই একটা যদি যোগাড় করে দিতে পারেন তবে–
বাধা দিয়ে রাজদূত বললেন, জর্মন সরকার যদি একটি মাত্র বৃত্তি একজন বিদেশীকেও দেন তবে আপনি সেটি পাবেন, আমি কথা দিচ্ছি।
আমি অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বললুম, পোয়েট টেগোরের কলেজে আমি পড়েছি, তিনি খুব সম্ভব আমাকে সার্টিফিকেট দিতে রাজী হবেন।
রাজদূত বললেন, তাহলে আপনি এত কষ্ট করে কাবুল এলেন কেন? টেগোরকে জর্মনিতে কে না চেনে?
আমি বললুম, কিন্তু পোয়েট সবাইকে অকাতরে সার্টিফিকেট দেন। এমন কি এক তেল-কোম্পানীকে পর্যন্ত সার্টিফিকেট দিয়েছেন যে, তাদের তেল ব্যবহার করলে নাকি টাকে চুল গজায়।
রাজদূত মৃদুহাস্য করে বললেন, টেগোর, বড় কবি জানতুম, কিন্তু এত সহৃদয় লোক সে-কথা জানতুম না।