সে রাত্রে গরম বানিয়ান, ফ্লানেলের শার্ট, পুল-ওভার, কোট, ইস্তক, ওভারকোট পরে শুলুম। উপরে দুখানা লেপ ও একখানা কার্পেট। মৌলানা তার প্রিয়তম গান ধরলেন,
দারুণ অগ্নিবাণে
হৃদয় তৃষায় হানে—
আমি সাধারণতঃ বেসুরা পোঁ ধরি। সেরাত্রে পারলুম না, আমার দাঁতে দাঁতে করতাল বাজছে।
জানালার ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকে পর্দা সরিয়ে দিল। আকাশ তারায় তারায় ভরা। রবীন্দ্রনাথ উপমা দিয়ে বলেছেন,
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যা তারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার আসে।
ফরাসী কবি অন্য তুলনা দিয়েছেন; আকাশের ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল জমে গিয়ে তারা হয়ে গিয়েছে। আরেক নাম-না-জানা বিদেশী কবি বলেছেন; মৃত ধরণীর কফিনের উপর সাজানো মোমবাতি গলে-যাওয়া জমে-ওঠা ফোঁটা ফোঁটা মোম তারা হয়ে গিয়েছে।
সব বাজে বাজে তুলনা, বাজে বাজে কাব্যি।
হে দিগম্বর ব্যোমকেশ, তোমার নীলাম্বরের নীলকম্বল যে লক্ষ লক্ষ তারার ফুটোয় ঝাজরা হয়ে গিয়েছে। তাই কি তুমিও আমারই মতন শীতে কাঁপছ? কাবুলে যে শ্মশান জ্বালিয়েছ তার আগুন পোয়াতে পারে না?
তিনদিন তিনরাত্তির লেপের তলা থেকে পারতপক্ষে বেরইনি। চতুর্থ দিনে আবদুর রহমান অনুনয় করে বলল, ওরকম একটানা শুয়ে থাকলে শরীর ভেঙে পড়বে সায়েব; একটু চলাফেরা করুন, গা গরম হবে।
আমাদের দেশের গরীব কেরানীকে যেরকম ডাক্তার প্রাতভ্রমণ করার উপদেশ দেয়। গরীব কেরানীরই মতন আমি চি চি করে বললুম, বড় ক্ষিধে পায় যে। শুয়ে থাকলে ক্ষিদে কম পায়।
ডাকাতি করলে আমি তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব এ কথা আবদুর রহমান জানত বলেই সে তখনো রাইফেল নিয়ে রাজভোগের সন্ধানে বেরোয়নি। আবদুর রহমান মাথা নিচু করে চুপ করে চলে গেল।
বেরাল পারতপক্ষে বাস্তুভিটা ছাড়ে না। তিনদিন ধরে আমার। বেরাল দুটো না-পাত্তা। তার থেকে বুঝলুম, আমার প্রতিবেশীরা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে ভালো খাওয়া দাওয়া করছে। তারা বিচক্ষণ, রাষ্ট্রবিপ্লবে ওকিবহাল। গোলমালের গোড়ার দিকেই সব কিছু কিনে রেখেছিল।
শীতের দেশে নাকি হাতী বেশীদিন বাঁচে না। তবু আমান উল্লা শখ করে একটা হাতী পুষেছিলেন। কাবুলে কলাগাছ আনারস গাছ, বনবাদাড় নেই বলে সে কালো হাতীকে পুষতে প্রায় সাদা হাতী পোষার খর্চাই লাগত। কাবুলে তখন কাঠের অভাব; তাই হাতী-ঘরে আর আগুন জ্বালানো হত না। বাচ্চার ডাকাত ভাইবেরাদরের শখ চেপেছে হাতী চাপার। সেই দুর্দান্ত শীতে তারা হাতীকে বের করেছে চড়ে নগরপ্রদক্ষিণ করার জন্য। তাকিয়ে দেখি হাতীর চোখের কোণ থেকে লম্বা লম্বা আইসিকুল বা বরফের ছুঁচ ঝুলছে— হাতীর চোখের আর্দ্রতা জমে গিয়ে।
আমি জানতুম, হাতীটা ত্রিপুরা থেকে কেনা হয়েছিল। ত্রিপুরার সঙ্গে সিলেটের বিয়ে-সাদী লেন-দেন বহুকালের সিলেটের জমিদার খুন করে ফেরারী হলে চিরকালই ত্রিপুরার পাহাড়ে টিপরাদের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।
হাতীটার কষ্ট আমার বুকে বাজলো। তখন মনে পড়ল রেমার্কের চাষা বন্দুকগুলী অগ্রাহ্য করে ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল, জখমি ঘোড়াকে গুলী করে মেরে তাকে তার যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি দেবার জন্য।
কুকুরের চোখেমুখে বেদনা সহজেই ধরা পড়ে। হাতীকে কাতর হতে কেউ কখনো দেখেনি, তাই তার বেদনাবোধ যখন প্রকাশ পায় তখন সে দৃশ্য বড় নিদারুণ।
আমান উল্লার বিস্তর মোটরগাড়ি ছিল। বাচ্চার সঙ্গী সাথীরা সেই মোটরগুলো চড়ে চড়ে তিন দিনের ভিতর সব পেট্রল শেষ করে দিল। শহরের সর্বত্র এখন দামী দামী মোটর পড়ে আছে— যেখানে যে-গাড়ির পেট্রল শেষ হয়েছে বাচ্চার ইয়াররা সেখানেই সে গাড়ি ফেলে চলে গিয়েছে। জানলার কাচ পর্যন্ত তুলে দিয়ে যায়নি বলে গাড়িতে বৃষ্টি বরফ ঢুকছে; পাড়ার ছেলেপিলেরা গাড়ি নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করাতে দু-একটা নর্দমায় কাত হয়ে পড়ে আছে।
আমাদের বাড়ির সামনে একখানা আনকোরা বীয়ুইক ঝলমল করছে। আবদুর রহমানের ভারী শখ গাড়িখানা বাড়ির ভিতরে টেনে আনার। বিদ্রোহ শেষ হলে চড়বার ভরসা সে রাখে।
আমান উল্লা তো সেই কোন্ ফরাসী রাজার মত আপ্রেমওয়া ল্য দেলজ (হম্ গয়া তো জগ গয়া) বলে কান্দাহার পালালেন,–আবদুর রহমান বলে, আপ্রে ল্য দেজ, অমবিল (বন্যার পর পলিমাটি)।
আমাদের কাছে যেমন সব ব্যাটা গোরার মুখ একরকম মনে হয়, আবদুর রহমানের কাছে তেমনি সব মোটরের এক চেহারা। কিছুতেই স্বীকার করবে না যে, দেলজের পর রাজবাড়ির লোক চোরাই-গাড়ির সন্ধানে বেরিয়ে গাড়িখানা চিনে নিয়ে সেখান পুরবে গারাজে আর তাকে পুরবে জেলে।
অপ্টিমিস্ট।
কাবুলে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। অনেকটা শিলঙের মত। হলে সবাই ছুটে ঘর থেকে বেরোয়।
দুপুরবেলা জোর ভূমিকম্প হল। আমি আর মৌলানা দুই খাটে শুয়ে ধুঁকছি। কেউ খাট ছেড়ে বেরলুম না।
৪১. অন্তহীন মহাকাল ভ্যাজর ভ্যাজর
যেন অন্তহীন মহাকাল ভ্যাজর ভ্যাজর করার পর এক ভাষণবিলাসী আপন বক্তৃতা শেষ করে বললেন, আপনাদের অনেক মূল্যবান সময় অজানতে নষ্ট করে ফেলেছি বলে মাপ চাইছি। আমার সামনে ঘড়ি ছিল না বলে সময়ের আন্দাজ রাখতে পারিনি। শ্রোতাদের একজন চটে গিয়ে বলল, কিন্তু সামনের দেয়ালে যে ক্যালেণ্ডার ছিল, তার কি? সেদিকে তাকালে না কেন?
মৌলানা আর আমি বহুদিন হল ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকানো বন্ধ করে দিয়েছি। তবু জমে-যাওয়া হাড় ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এখনো শীতকাল।।