দিগ্বিজয় করে বুদ্ধদেব যখন কপিলবস্তু ফিরেছিলেন তখন যশোধরা এমনি ধারা অভিমান করেছিলেন।
———–
* আমান উল্লা কথার অর্থ আল্লার আমানত এবং ফী আমান উল্লা কথার অর্থ (তোমাকে) আল্লার আমানতে রাখলুম।
৪০. ফরাসডাঙার জরিপেড়ে ধুতি
ফরাসডাঙার জরিপেড়ে ধুতি, গরদের পাঞ্জাবী আর ফুরফুরে রেশমি উড়নি পড়ে বসে আছি। কব্জিতে গোড়ে, গোঁফে আতর। চাকর ট্যাক্সি আনতে গিয়েছে— বায়স্কোপে যাব।
সত্যি নয়, তুলনা দিয়ে বলছি।
তখন যেমন ট্যাক্সির অপেক্ষা করা ভিন্ন অন্য কোনো কাজে মন দেওয়া যায় না আমাদের অবস্থা হল তখন তাই। তফাত শুধু এই, র ফ্রান্সিসের হাতে হাওয়াই ট্যাক্সি রয়েছে কিন্তু সাঁঝের বেলা শিখ ড্রাইভার যে রকম মদমত্ত হয়ে চক্ষু দুইডা রাঙা কইরা, এড়া চিকৈর দিয়া বলে নহী জায়েঙ্গে সায়েব তেমনি স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে বলছেন–চুলোয় যাকগে কি বলছেন।
অপেক্ষা করে করে একমাস কাটিয়ে দিয়েছি।
চা ফুরিয়ে গিয়েছে–ক্ষুদা মারবার আর কোনো দাওয়াই নেই। এখন শুধু রুটি আর নুন— নুন আর রুটি। রুটিতে প্রচুর পরিমাণ মুন দিলে শুধু রুটিতেই চলে কিন্তু ভোজনের পদ বাড়াবার জন্য আবদুর রহমান মুন রুটি আলাদা আলাদা করে পরিবেষণ করত।
সপ্তাহ তিনেক হল বেনওয়া সায়েব অ্যারোপ্লেন করে হিন্দুস্থান চলে গিয়েছেন। পূর্বেই বলেছি, তিনি শান্তিনিকেতনে থেকে থেকে বাঙালী হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা হলে কি হয়। পাসপোর্ট খানা তো ফরাসী দেশের এবং তার রংটা তো সাদা। তাই ভারতীয় বিমানে তিনি জায়গা পেলেন বিনা মেহেন্নতে। আমাদের তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই কিন্তু সব ফরাসীর জন্য তো আর এ রকম দরাজদিল হতে পারব না।
যাবার আগের দিন বেনওয়া বাড়িতে এসে মৌলানা আর আমাকে গোপনে এক টিন ফরাসী তরকারি দিয়ে যান— সার্ডিন টিনের সাইজ। বহুকাল ধরে রুটি ভিন্ন অন্য কোনো বস্তু পেটে পড়েনি; মৌলানাতে আমাতে সেই তরকারি গো-গ্রাসে গোস্তগেলার পদ্ধতিতে খেয়ে পেটের অসুখে সপ্তাহ খানেক ভুগলুম। আমাদের ভুগন্তি অনেকটা গরীব চাষীর ম্যালেরিয়ায় ভোগার মত হল। চাষী যে রকম ভোগর সময় বিলক্ষণ বুঝতে পারে কুইনিন ফুইনিন কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই, সাতদিন পেট ভরে খেতে পেলে দুনিয়ার কুল্লে জ্বর ঝেড়ে ফেলে উঠতে পারবে, আমরা তেমনি ঠিক জানতুম, তিন দিন পেট ভরে খেতে পেলে আমাদেরও পেটের অসুখ আমান উল্লার সৈন্য বাহিনীর মত কপূর হয়ে উবে যাবে।
সেই অনাহার আর অসুখের দরুন মৌলানা আর আমার মেজাজ তখন এমনি তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছে যে, বেরালটা কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে তার শব্দে লাফ দিয়ে উঠি (অথচ স্নায়ু জিনিসটা এমনি অদ্ভুত যে, বন্দুকগুলীর শব্দে আমাদের নিদ্রা ভঙ্গ হয় না), কথায় কথায় দুজনাতে তর্ক লাগে, মৌলানার দিকে তাকালেই আমার মনে হয় ওরকম জঙলী দাড়ি মানুষ রাখে কেন, মৌলানা আমার চেহারা সম্বন্ধে কি ভাবতেন জানিনে, তবে প্রকাশ করলে খুব সম্ভব খুনোখুনি হয়ে যেত। মৌলানা পাঞ্জাবী কিন্তু আমিও তো বাঙাল।।
মৌলানা লোকটা ভারী কুতর্ক করে। আমি যা বললুম সে কথা তাবৎ দুনিয়া সৃষ্টির আদিম কাল থেকে স্বীকার করে আসছে। আমি বললুম, সরু চালের ভাত আর ইলিশমাছভাজার চেয়ে উপাদেয় খাদ্য আর কিছুই হতে পারে না। মূর্খ বলে কি না বিরয়ানিকুৰ্মা তার চেয়ে অনেক ভালো। পাঞ্জাবীর সঙ্কীর্ণমনা প্রাদেশিকতার আর কি উদাহরণ দিই বলুন। শান্তিনিকেতনে থেকেও লোকটা মানুষ হল না। যে নরাধম ইলিশমাছের অপমান করে তার মুখদর্শন করা মহাপাপ, অথচ দেখুন, বাঙালীর চরিত্র কী উদার, কী মহান;–আমি মৌলানার সঙ্গে মাত্র তিন দিন কথা বন্ধ করে ছিলুম।
আর শীতটা যা পড়েছিল। বায়স্কোপে জব্বর গরমের ছহাজার ফুটী বর্ণনা দেখা যায়, কিন্তু মারাত্মক শীতের বয়ান তার তুলনায় বহুৎ কম। কারণ বায়স্কোপ বানানো হয় প্রধানতঃ সায়েব বোদের জন্য আর তেনারা শীতের তকলিফ বাবতে ওকিবহাল, কাজেই সে-জিনিস তাদের দেখিয়ে বক্স-আপিস ভরবে কেন? আর যদি বা দেখানো হয় তবে শীতের সঙ্গে হামেশাই ঝড় বা ব্লিজার্ড জুড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আসলে যেমন কালবৈশাখী বিপজ্জনক হলেও তার সঙ্গে দিনের পর দিনের ১১২ ডিগ্রীর অত্যাচারের তুলনা হয় না, তেমনি বরফের ঝড়ের চেয়েও মারাত্মক দিনের পর দিনের ১০ ডিগ্রীর অত্যাচার।
জামা ধুয়ে নোন্দরে শুকোতে দিলেন। জামার জল জমে বরফ হল, রোদ্দু রে সে জল শুকোনো দূরের কথা বরফ পর্যন্ত গলল না। রোদ থাকলেই টেম্পারেচার ফ্রিজিঙের উপরে ওঠে না। জামাটা জমে তখন এমনি শক্ত হয়ে গিয়েছে যে, এক কোণে ধরে রাখলে সমস্ত জামাটা খাড়া হয়ে থাকে। ঘরের ভিতরে এনে আগুনের কাছে ধরলে পর জামা চুবসে গিয়ে জবুথবু হয়।
বলবেন বানিয়ে বলছি, কিন্তু দেশ ভ্রমণের হলপ, দোতলা থেকে থুথু ফেললে সে-থুথু মাটি পৌঁছবার পূর্বেই জমে গিয়ে পেঁজা বরফের মত হয়ে যায়। আবদুর রহমান একদিন দুটো পেঁয়াজ যোগার করে এনেছিল–খুদায় মালুম চুরি না ডাকাতি করে–কেটে দেখি পেঁয়াজের রস জমে গিয়ে পরতে পরতে বরফের গুড়ো হয়ে গিয়েছে।
সেই শীতে জ্বালানী কাঠ ফুরোলো।
খবরটা আবদুর রহমান দিল বেলা বারোটার সময়। বাইরের কড়া রৌদ্র তখন বরফের উপর পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, আমরা কিন্তু সে-সংবাদ শুনে ত্রিভুবন অন্ধকার দেখলুম। রোদ সত্ত্বেও টেম্পারেচার তখন ফ্রিজিঙপয়েন্টের বহু নিচে।