ব্যাপারটা বুঝতে আবদুর রহমানের একটু সময় লাগল। যখন বুঝল, তখন চুপ করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমারও মন খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু করিই বা কি? আবদুর রহমানের সঙ্গে বহু সন্ধ্যা, বহু যামিনী কাটিয়ে বুঝতে পেরেছি যে, সে যদি নিজের থেকে কোনো জিনিস না বোঝে, তবে আমার যুক্তিতর্ক তার মনের কোনো কোণে ঠাঁই পায় না। আমার ব্যবস্থাটা যে তার আদপেই পছন্দ হয়নি, সেটা বুঝতে পারলুম, কিন্তু আমি আশা করেছিলুম, সে আপত্তি জানাবে, আমি তাহলে তর্কাতর্কি করে তাকে খানিকটা শায়েস্তা করে নিয়ে আসব। দেখলুম তা নয়, সরল শোক আর সোজা সুপারি গাছে মিল রয়েছে; একবার পা হড়কালে আপত্তি-অজুহাতের শাখা-প্রশাখা নেই বলে সোজা ভূমিতলে অবতরণ।।
খানিকক্ষণ পরে নিজের থেকেই ঘরে ফিরে এল। মাথা নিচু করে বলল, আপনি নিজের হাতে মেপে সকাল বেলা দুমুঠো আটা দেবেন। আমার তাইতেই চলবে।
কি করে লোকটাকে বোঝাই যে, আমার অজানা নয় সে মাসখানেক ধরে দুমুঠো আটা দিয়েই দুবেলা চালাচ্ছে। আর খাবারের কথাই তো আসল কথা নয়। আমার প্রস্তাবে যে সে অত্যন্ত বেদনা অনুভব করেছে, সেটা লাঘব করি কি করে? যুক্তিতর্ক তো বৃথা পূর্বেই বলেছি, ভাবলুম, মৌলানাকে ডাকি। কিন্তু ডাকতে হল না। আবদুর রহমান বলল, যখন সবকিছু পাওয়া যেত, তখন আমি এখানে যা খেয়েছি, আমার বাবা তার শ্বশুর বাড়িতেও সেরকম খায়নি। তারপর বেশ একটু গলা চড়িয়ে বলল, আর আজ কিছু জুটছে না বলে আমাকে খেদিয়ে দিতে চান? আমি কি এতই নিমকহারাম?
অনেক কিছু বলল। কিছুটা যুক্তি, বেশীর ভাগ জীবনস্মৃতি, অল্পবিস্তর ভর্ৎসনা, সবকিছু ছাপিয়ে অভিমান। কখনো বলে, দেরেশি করিয়ে দেননি, কখনো বলে, নূতন লেপ কিনে দেননি কাবুলের কটা সর্দারের ওরকম লেপ আছে, আমি গেলে বাড়ি পাহারা দেবে কে, আমাকে তাড়িয়ে দেবার হক আপনার সম্পূর্ণ আছে— আপনার আমি কি খেদমত করতে পেরেছি?
যেন পানশিরের বরফপাত। গাদাগাদা, পাঁজা-পাঁজা। আমি যেন রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, আর আমার উপর সে বরফ জমে উঠছে। আবদুর রহমানই আমাদের প্রথম পরিচয়ের দিন বলেছিল, তখন নাকি সেই বরফ-আস্তরণের ভিতর বেশ ওম বোধ হয়। আমিও আরাম বোধ করলুম।
কিন্তু না খেতে পেয়ে আবদুর রহমানের পানশিরী তাগদ মিইয়ে গিয়েছে। সাত দিন ধরে বরফ পড়ল না— মিনিট খানেক বর্ষণ করেই আবদুর রহমান থেমে গেল। আমি বললুম, তা তো বটেই, তুমি চলে গেলে আমাকে বাঁচাবে কে? অতটা ভেবে দেখিনি।
আবদুর রহমান তদ্দণ্ডেই খুশ। সরল লোককে নিয়ে এই হল মস্ত সুবিধে। তক্ষুনি হাসিমুখে আগুনের তদারকিতে বসে গেল।
তারপর মন থেকে যে শেষ গ্লানিটুকু কেটে গিয়েছে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলুম শুতে যাবার সময়। তোষকের তলায় লেপ গুঁজে দিতে দিতে বলল, জানেন, সায়েব, আমি যদি বাড়ি চলে যাই তবে বাবা কি করবে? প্রথম আমার কাছ থেকে একটা বুলেটের দাম চেয়ে নেবে; তারপর আমাকে গুলী করে মারবে। কতবার আমাকে বলেছে, তোর মত হতভাগাকে মারবার জন্য যে গাঁটের পয়সায় বুলেট কেনে সে তোর চেয়েও হতভাগা।
আমি বললুম, ও, তাই বুঝি তুমি পানশির যেতে চাও না? প্রাণের ভয়ে?
আবদুর রহমান প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেল। তারপর হাসল। আমারও হাসি পেল যে আবদুর রহমান এতদিন ধরে শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠতি অগ্রে রূপ ধারণ করে বিরাজ করত আমার আলবাল-সিঞ্চনে সে যে একদিন রসবোধকিশলয়ে মুকুলিত হয়ে সরসতরুবর হবে সে আশা করিনি।
আবদুর রহমান একখানা খোলা-চিঠি দিয়ে গেল; উপরে আমান উল্লার পলায়নের তারিখ।
কমরত ব্ শিকনদ–
এতদিন বাদে মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। আগা আহমদের মাইনের পাঁচবছরের জমানো তিন শ টাকা আর তার ভাইয়ের রাইফেল লোপাট মেরে আফ্রিদী মুল্লুকে চললুম। সেখানে গিয়ে পিতৃ-পিতামহের ব্যবসা ফাঁদব। শুনতে পাই খাইবারপাসের ইংরেজ অফিসার পাকড়ে পাকড়ে খালাসীর পয়সা আদায় করার প্রাচীন ব্যবসা উপযুক্ত লোকের অভাবে অত্যন্ত দুরবস্থায় পড়েছে।
কিন্তু আচ্ছা ইংরিজী জাননেওয়ালা একজন দোভাষীর আমার প্রয়োজন— আমার ইংরিজী বিদ্যে তো জান! তোমার যদি কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকে তবে পত্রপাঠ জলালাবাদের বাজারে এসে আমার অনুসন্ধান করো। মাইনে? কাবুলে এক বছরে যা কামাও, আমি এক মাসে তোমাকে তাই দেব। কাবুলের ডাকাতের চাকর হওয়ার চেয়ে আমার বেরাদর হয়ে ইমান-ইনসাফে কামানো
পয়সার বখরাদার হওয়া ঢের ভালো।
আমান উল্লা নেই— তবু ফী আমানিল্লা।*
দোস্ত মুহম্মদ
পুঃ আগা আহমদ সঙ্গে আছে। কাঁধে আমান উল্লার বিলি করা একখানা উৎকৃষ্ট মাউজার রাইফেল।
রাজা হয়ে ভিস্তিওয়ালার ডাকাত ছেলে ইচ্ছাঅনিচ্ছায় রাজপ্রাসাদে কি রঙ্গরস করল তার গল্প আস্তে আস্তে বাজারময় ছড়াতে আরম্ভ করল। আধুনিক ঔপন্যাসিকের বালীগঞ্জের কাল্পনিক ডাইনিঙরুমে পাড়াগেঁয়ে ছেলে যা করে তারই রাজসংস্করণ। নূতনত্ব কিছু নেই। তবে একটা গল্প আমার বড় ভালো লাগল। মৌলানার কপি রাইট।
আমান উল্লা লণ্ডনে পঞ্চম জর্জের সঙ্গে যে রোলস-রয়েস চড়ে কুচকাওয়াজ পালাপরবে যেতেন রাজা জর্জ সেই বজরার মত মোটর আমান উল্লাকে বিদায়-ভেট দেন। সে গাড়ি রাক্ষসের মত তেল খেত বলে আমান উল্লা পালাবার সময় সেখানা কাবুলে ফেলে যান।
বাচ্চা রাজা হয়ে বিশেষ করে সেই মোটরই পাঠাল বাস্তুগাঁয়ে বউকে নিয়ে আসবার জন্য। বউ নাকি তখন বাচ্চার বাচ্চার মাথার উকুন বাছছিল। সারা গায়ের হুলুস্কুলের মাঝখানে বাচ্চার বউ নাকি ড্রাইভারকে বলল, তোমার মনিবকে গিয়ে বলল, নিজে এসে আমাকে খচ্চরে বসিয়ে যেন নিয়ে যায়।