মৌলানা কবিতা আওড়ালেন আরেক মৌলানার–কবি সাদীর —
চূন আহঙ্গে রক্ত কুন জানে পাক্,
চি বর তখ্ৎ মুরদন্ চি বর্ সরে খাক্?
পরমায়ু যবে প্রস্তুত হয় মহাপ্রস্থান তরে
একই মৃত্যু–সিংহাসনেতে অথবা ধূলির পরে।
বাচ্চার ফরমান জারির দিন সাতেক পরে ভারতীয়, ফরাসী, জর্মন শিক্ষক-অধ্যাপকেরা এক ঘরোয়া সভায় স্থির করলেন, স্যার ফ্রান্সিসকে তাদের দুরবস্থা নিবেদন করে হাওয়াই জাহাজে করে ভারতবর্ষে যাওয়ার জন্য বন্দোবস্ত ভিক্ষা করা।
অধ্যাপকেরা বললেন, কাবুল থেকে বেরবার রাস্তা চতুর্দিকে বন্ধ; স্যার ফ্রান্সিস বললেন, হাঁ; অধ্যাপকেরা নিবেদন করলেন, কাবুলে কোনো ব্যাঙ্ক নেই বলে তাদের জমানো যা কিছু সম্বল তা পেশাওয়ারে এবং সে পয়সা আবার কোনো উপায় নেই; স্যার ফ্রান্সিস বললে, হুঁ; অধ্যাপকেরা কাতর অনুনয়ে জানালেন, স্ত্রী-পরিবার নিয়ে তারা অনাহারে আছেন; সায়েব বললেন, অ; অধ্যাপকেরা মরীয়া হয়ে বললেন, এখানে থাকলে তিলে তিলে মৃত্যু; সায়েব বললেন, আ।
একদিকে ফুল্লরার বারমাসী, অন্যদিকে সায়েবের অ, আ করে বর্ণমালা পাঠ। ক্লাশ সিক্সের ছেলে আর প্রথম ভাগের খোকাবাবু যেন একই ঘরে পড়াশোনা করছেন।
বর্ণমালা যখন নিতান্তই শেষ হয়ে গেল তখন সায়েব বললেন, এখানকার ব্রিটিশ লিগেশন ইংলণ্ডের ব্রিটিশ সরকারের মুখপাত্র। ভারতবাসীদের সুখ-সুবিধা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ব্রিটিশ লিগেশনের কর্তব্য নয়। আমি যদি কিছু করতে পারি, তবে সেটা ফেবার হিসেবে করব, আপনাদের কোনো রাইট নেই।
যাত্রাগানে বিস্তর দুর্যোধন দেখেছি। সায়েবের চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি, না, কিছু কিছু গরমিল রয়েছে। দুর্যোধন ফেবার, রাইট কোনো হিসেবেই পাঁচখানা গাঁ দিতে রাজী হননি, ইনি ফেবারেবল কনসিডারেশন করতে রাজী আছেন।
এ অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ হলে হয়ত তিনি বগল বাজিয়ে সুখবর দেবার জন্য পাণ্ডব-শিবিরে ছুটে যেতেন, কিন্তু আমার মনে পড়ল যুধিষ্ঠিরের কথা। একটি মিথ্যে কথা বলবার জন্যে তাঁকে নরক দর্শন করতে হয়েছিল। ভাবলুম, এদিকে দুর্যোধন, ওদিকে বাচ্চায়ে সকাও, এর মাঝখানে যদি সাহস সঞ্চয় করে একটিবারের মত এই জীবনে সত্যি কথা বলে ফেলতে পারি তবে অন্তত একবারের মত স্বর্গ দর্শন লাভ হলে হতেও পারে। বললুম, হাওয়াই জাহাজগুলো ভারতীয় পয়সায় কেনা, পাইলটরা ভারতীয় তনখা খায়, পেশাওয়ারের বিমানঘাঁটি ভারতের নিজস্ব— এ অবস্থায় আমাদের কি কোনো হক নেই? ব্রিটিশ লিগেশন যে ভারতীয় অর্থে তৈরি, সায়েব যে ভারতীয় নিমক খান, সেকথা আর ভদ্রতা করে বললুম না।
সায়েব ভয়ঙ্কর চটে গেলেন, অধ্যাপকরাও ভয় পেয়ে গেলেন। বুঝলুম, জীবনমরণের ব্যাপার— ভারতীয়েরা কোনো গতিকে দেশে ফিরে যেতে পেলে রক্ষা পান মেহেরবানী, হক নিয়ে নাহক তর্ক করে কোনো লাভ নেই। বললুম, আমি যা বলেছি, সে আমার ব্যক্তিগত মত। আমি নিজে কোনো ফেবার চাইনে, কিন্তু আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা যেন আর পাঁচজনের স্বার্থে আঘাত না করে।
এর পর কথা কাটাকাটি করে আর কোনো লাভ নেই। আমার যা বক্তব্য সায়েব পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন, আর সায়েবের বক্তব্য ভারতবাসীর কাছে কিছু নূতন নয়— ফেবার শব্দ দরখাস্তে যিনি যত ইনিয়ে-বিনিয়ে লিখতে পারেন, তাকেই আমরা ভারতবর্ষে গেল এক শ বছর ধরে ইংরিজীতে সুপণ্ডিত বলে সেলাম করে আসছি।
সেই সন্ধ্যায়ই খবর পেলুম, যে সব ভারতবাসী স্বদেশে ফিরে যেতে চান, তাদের একটা ফিরিস্তি তৈরি করা হয়েছে। সায়েব স্বহস্তে আমার নামে ঢ্যারা কেটে দিয়েছেন।
আবদুর রহমান এখন শুধু আগুনের তদারকি করে। বাদাম নেই যে, খোসা ছাড়াবে, কালি নেই যে, জুতো পালিশ করবে। না খেয়ে খেয়ে রোগা হয়ে গিয়েছে, দেখলে দুঃখ হয়।
মৌলানা শুতে গিয়েছেন। আবদুর রহমান ঘরে ঢুকল। আমি বললুম, আবদুর রহমান, সব দিকে তো ডাকাতের পাল রাস্তা বন্ধ করে আছে। পানশিরে যাবার উপায় আছে?
আবদুর রহমান আমার দুহাত আপন হাতে তুলে নিয়ে শুধু চুমো খায়, আর চোখে চেপে ধরে; বলে, সেই ভালো হুজুর, সেই ভালো। চলুন আমার দেশে। এরকম শুকনো রুটি আর মুন খেলে দুদিন বাদে আপনি আর বিছানা থেকে উঠতে পারবেন না। তার চেয়ে ভালো খাওয়ার জিনিষ আমাদেরই বাড়িতে আছে। কিছু না হোক, বাদাম, কিসমিস, পেস্তা, আঞ্জীর, মোলায়েম পনীর, আর হুজুর, আমার নিজের তিনটে দুম্বা আছে। আর একটি মাস, জোর দেড় মাস, তারপর বরফ গলতে আরম্ভ করলেই আপনাকে নদী থেকে মাছ ধরে এনে খাওয়াব। ভেজে, সেঁকে, পুড়িয়ে যেরকম আপনার ভালো লাগে। আপনি আমাকে মাছের কত গল্প বলেছেন, আমি আপনাকে খাইয়ে দেখাব। আরামে শোবেন, ঘুমবেন, জানলা দিয়ে দেখবেন—
আবদুর রহমানকে বাধা দিতে কষ্টবোধ হল। বেচারী অনেক দিন পরে আবার প্রাণ খুলে কথা বলতে আরম্ভ করেছে, পানশিরের পুরানো স্বপ্নে নূতন রঙ লাগিয়ে আমার চোখে চটক লাগাবার চেষ্টা করছে; তার মাঝখানে ভোরের কাকের কর্কশ কা-কা করে তার সুখ-স্বপ্ন কেটে ফেলতে অত্যন্ত বাধো বাধো ঠেকল। বললুম, না, আবদুর রহমান, আমি যাব না, আমি বলছি, তুমি চলে যাও। জানো তো আমার চাকরি গেছে, তোমাকে মাইনে দেবার টাকা আমার নেই। ডাল-চাল ফুরিয়ে গিয়ে গমে এসে ঠেকেছে, তাও তো আর বেশী দিন চলবে না। তুমি বাড়ি চলে যাও, খুদা যদি ফের সুদিন করেন, তবে আবার দেখা হবে।