জিন্দাবাদ বাদশাহ গাজী হবীব উল্লা খান।
বর্বরদেশে নতুন দলপতি উদূখলে বসলে নরবলি করার প্রথা আছে। আফগানিস্থানে এরকম প্রথা থাকার কথা নয়, তবু অনিচ্ছায় গোটা পাঁচেক নরবলি হয়ে গেল। শাদীয়ানার হাজার হাজার বুলেট আকাশ থেকে নামার সময় যাদের মাথায় পড়ল তাদের কেউ কেউ মরল–পুরু মীর আসলমী পাগড়ি মাথায় প্যাচানো ছিল না বলে।
পাগড়ি নিয়ে হেলাফেলা করতে নেই। গরীব আফগানের মামুলী পাগড়ি নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে গিয়ে আমান উল্লার রাজমুকুট খসে পড়ল।
৩৯. আমান উল্লা কাফির
ডাকাত সেটা কুড়িয়ে নিয়ে মাথায় পড়ল।
মোল্লারা আশীর্বাদ করলেন।
পরদিন ফরমান বেরলো। তার মূল বক্তব্য, আমান উল্লা কাফির, কারণ সে ছেলেদের এলজেব্রা শেখাত, ভূগোল পড়াত, বলত পৃথিবী গোল। বিংশ শতাব্দীতে এ রকম ফরমান বেরতে পারে সে কথা কেউ সহজে বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু বাচ্চার মত ডাকাত যখন তখ-নশীন হতে পারে তখন এরকম ফরমান আর অবিশ্বাস করার কোনো উপায় থাকে না। শুধু তাই নয়, ফরমানের তলায় মোল্লাদের সই ছাড়াও দেখতে পেলুম সই রয়েছে আমান উল্লার মন্ত্রীদের।
মীর আসলম বললেন, পেটের উপর সঙ্গীন ঠেকিয়া সইগুলো আদায় করা হয়েছে। না হলে বলো, কোন্ সুস্থ লোক বাচ্চাকে বাদশাহী দেবার ফরমানে নাম সই করতে পারে? রাগের চোটে
তার চোখ-মুখ তখন লাল হয়ে গিয়েছে, দাড়ি ডাইনে-বাঁয়ে ছড়িয়ে। পড়েছে। গর্জন করে বললেন, ওয়াজিব-উ-কল প্রত্যেক মুসলমানের উচিত যাকে দেখা মাত্র কতল করা সে কি না বাদশাহ হল!
আমি বললুম, আপনি যা বলছেন তা খুবই ঠিক; কিন্তু আশা করি এসব কথা যেখানে সেখানে বলে বেড়াচ্ছেন না।
মীর আসলম বললেন, শোনন, সৈয়দ মুজতবা আলী, আমান উল্লার নিন্দা যখন আমি করেছি তখন সকলের সামনেই করেছি; বাচ্চায়ে সকাওয়ের বিরুদ্ধে যা বলবার তাও আমি প্রকাশ্যে বলি। তুমি কি ভাবছ কাবুল শহরের মোল্লারা আমাকে চেনে না, ফরমানের তলায় আমার সই লাগাতে পারলে ওরা খুশী হয় না? কিন্তু ওরা ভালো করেই জানে যে, আমার বাঁ হাত কেটে ফেললেও আমার ডান হাত সই করবে না। ওরা ভালো করেই জানে যে, আমি ফতোয়া দিয়ে বসে আছি, বাচ্চায়ে সকাও ওয়াজিব্-উ্ল্-কৎল–অবশ্য বধ্য।
মীর আসলম চলে যাওয়ার পর মৌলানা বললেন, যতদিন আফগানিস্থানে মীর আলমের মত একটি লোকও বেঁচে থাকবেন ততদিন এ দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমি সায় দিয়ে বললুম, হক কথা, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যতের ভাবনা এই বেলা একটু ভেবে নিলে ভালো হয় না?
দুজনে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলুম : কখনো মুখ ফুটে কখনো যার যার আপন মনে। বিষয় : বাচ্চা তার ফরমানে আমান উল্লা যে কাফির সে কথা সপ্রমাণ করে বলেছে, এবং যেসব দেশী-বিদেশী মাস্টার প্রফেসর আমান উল্লাকে এ সব কর্মে সাহায্য করত, তাদের ডিসমিস করা হল; স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হল।
শেষটায় মৌলানা বললেন, অত ভেবে কন্দ হবে। আমরা ছাড়া আরো লোকও তো ডিসমিস হয়েছে দেখাই যাক না তারা কি করে। মৌলানার বিশ্বাস দশটা গাধা মিললে একটা ঘোড়া হয়।
কিন্তু এসব নিতান্ত ব্যক্তিগত কথা।
আবু হৌসেন নাটক যারা দেখেছেন, তাঁরা হয়ত ভাবছেন যে, কাবুলে তখন জোর রগড়। কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনায় তখন আমীর ফকির সকলেরই রসকষ কাবুল নদীর জলের মত জমে গিয়ে বরফ হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাও শহরবাসীকে সন্দেহের দোদুলদোলায় বেশীক্ষণ দোলালো না। হুকুম হলে আমান উল্লার মন্ত্রীদের ধরে নিয়ে এসো, আর তাদের বাড়ি লুঠ করো।
সে লুঠ কিস্তিতে কিস্তিতে হল। বাচ্চার খাস-পেয়ারারা প্রথম খবর পেয়েছিল বলে তারা প্রথম কিস্তিতে টাকা-পয়সা, গয়নাগাটী দামী টুকিটাকি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় কিস্তিতে সাধারণ ডাকাতরা আসবাবপত্র, কার্পেট, বাসন-কোসন, জামা-কাপড় বেছে বেছে নিয়ে গেল, তৃতীয় কিস্তিতে আর সব ঝড়ের মুখে উড়ে গেল শেষটায় রাস্তার লোক কাঠের দরজা-জানালা পর্যন্ত ভেঙে নিয়ে গিয়ে শীত ভাঙালো।।
মন্ত্রীদের খালি পায়ে বরফের উপর দাঁড় করিয়ে হরেক রকম সম্ভব অসম্ভব অত্যাচার করা হল গুপ্তধন বের করবার আশায়। তার বর্ণনা শুনে কাবুলের লোক পর্যন্ত শিউরে উঠেছিল মৌলানা আর আমি শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিলুম।
তারপর আমান উল্লার ইয়ারবক্সি, ফৌজের অফিসারদের পালা। বন্ধ দোর-জানালা ভেদ করে গভীর রাত্রে চিৎকার আসত ডাকু পড়েছে। সে আবার সরকারী ডাকু তার সঙ্গে লড়াই করার উপায় নেই, তার হাত থেকে পালাবার পথ নেই।
কিন্তু অভ্যাস হয়ে গেল রাস্তার উপর শীতে জমে-যাওয়া রক্ত, উলঙ্গ মড়া, রাত্রে ভীত নরনারীর আর্ত চিৎকার সবই সত্য হয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, অভ্যাস হল না শুধু শুকনো রুটি, নুন আর বিনা দুধ চিনিতে চা খাওয়ার। মায়ের কথা মনে পড়ল; তিনি একদিন বলেছিলেন, চা-বাগানের কুলীরা যে প্রচুর পরিমাণে বিনা দুধ চিনিতে লিকার খায় সে পানের তৃপ্তির জন্য নয়, ক্ষুধা মারবার জন্য। দেখলুম অতি সত্যি কথা, কিন্তু শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। কাবুলে ম্যালেরিয়া নেই, থাকলে তারপর চা-বাগানের কুলীর যা হয়, আমারও তাই হত এবং তার পরমা গতি কোথায়, বাঙালীকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। মৌলানাকে জিজ্ঞেস করলুম, না খেতে পেয়ে, বুলেট খেয়ে, ম্যালেরিয়ায় ভুগে, এ-তিন মার্গের ভিতর মরার পক্ষে কোনটা প্রশস্ততম বলো তো।