মৌলানা বললেন, বাচ্চা এখন আর কাবুলের মহল্লা-সদারদের কেয়ার করে না। তারপর আবদুর রহমানকে পার্লিমেন্টি কায়দায় সপ্লিমেন্টরি শুধালেন, আর্কে কি পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য আছে? সৈন্যরা টিকতে পারবে কতদিন? আবদুর রহমান কঁচা ডিপ্লোমেট নোটিসের হুমকি দিল না। বলল, অন্তত ছয় মাস।
তৃতীয় দিনের বুলেটিন বাচ্চা বলেছে, ইনায়েত উল্লা যদি আত্মসমর্পণ না করেন তবে যে-সব আমীর-ওমরাহ সেপাই-সান্ত্রী তার সঙ্গে আর্কে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের স্ত্রীপুত্ৰপরিবারকে সে খুন করবে। ইনায়েত উল্লা উত্তর দিয়েছেন, কুছ পরোয়া নেই।
ফালতো প্রশ্ন, বাচ্চা দুর্গ আক্রমণ করছে না কেন?
অবজ্ঞাসূচক উত্তর, রাইফেলের গুলী দিয়ে পাথরের দেয়াল ভাঙা যায় না।
সে সন্ধ্যায় ব্রিটিশ লিগেশনের এক কেরানী প্রাণের ভয়ে আমার বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। শহরে এসেছিলেন কি কাজে; বাচ্চার ফৌজ দলে দলে শহরে ঢুকছিল বলে লিগেশনে ফিরে যেতে পারেননি। রাত্রে তাঁর মুখে শুনলুম যে, দুর্গের ভিতরে বন্ধ আমীর-ওমরাহদের স্ত্রীপুত্ৰপরিবার দুর্গের বাইরে। ইনায়েত উল্লার পরিবার দুর্গের ভিতরে। আমীরগণ ও বাদশাহের স্বার্থ এখন আর সম্পূর্ণ এক নয়। আমীরগণ তাদের পরিবার বাঁচাবার জন্য আত্মসমর্পণ বরতে চান। ইনায়েত উল্লা নাকি নিরাশ হয়ে বলেছেন, যেসব আমীর-ওমরাহদের অনুরোধে তিনি অনিচ্ছায় রাজা হয়েছিলেন, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখন তিনি আর দুর্গ রক্ষা করতে রাজী নন।
আবদুর রহমান সভাস্থলে উপস্থিত ছিল। বলল, আমি শুনেছি, সেপাইরা দুর্গ রক্ষা করতে রাজী, যদিও তাদের পরিবার দুর্গের বাইরে। তারা বলছে, বউবাচ্চার জান আমানত দিয়ে তো আর ফৌজে ঢুকিনি। ভয় পেয়েছেন অফিসার আর আমীর-ওমরাহদের দল।
কেরানী বললেন, আমিও শুনেছি, কিন্তু কোনটা খাঁটী কোনটা ঝুটা বুঝবার উপায় নেই। মোদ্দা কথা, ইনায়েত উল্লা সিংহাসন ত্যাগ করতে তৈরি, তবে তার শর্ত : কোনো তৃতীয়পক্ষ যেন তিনি আর তার পরিবারকে নিরাপদে আফগানিস্থানের বাইরে নিয়ে যাবার জিম্মাদারি নেন। স্যার ফ্রান্সিস রাজী হয়েছেন।
আমরা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, স্যার ফ্রান্সিসের কাছে প্রস্তাবটা পাড়ল কে?
বলা শক্ত। শোরবাজার, ইনায়েত উল্লা, বাচ্চা থুড়িহবীব উল্লা খান— তিনজনের একজন, অথবা সকলে মিলে। এখন সেই কথাবার্তা চলছে।
সেরাত্রে অনেকক্ষণ অবধি মৌলানা আর কেরানী সায়েবেতে আফগান রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক হল।।
সকালবেলা আবদুর রহমান হাতে-সেঁকা রুটি, নুন আর বিনা দুধ চিনিতে চা দিয়ে গেল। আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভদ্রলোক কিছুই স্পর্শ করতে পারলেন না। প্রবাদ আছে, কাজীর বাড়ির বাদীও তিন কলম লিখতে পারে। বুঝতে পারলুম, ব্রিটিশ রাজদূতাবাসের কেরানীও রাজভোগ খায়— এই দুর্ভিক্ষেও।
দুপুরের দিকে কেরানী সায়েবের সঙ্গে শহরে বেরলুম। বাচ্চার সেপাইয়ে সমস্ত শহর ভরে গিয়েছে। আর্কের পাশের বড় রাস্তায় তার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি–তিনি লিগেশনে যাবেন, আমি বাড়ি ফিরব এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই এক সঙ্গে শ খানেক রাইফেল আমাদের চারপাশে গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দেখি, রাস্তার লোকজন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে যে যেদিকে পারে সেদিকে ছুটছে। আশ্রয়ের সন্ধানে নিশ্চয়ই, কিন্তু কে কোন্ দিকে যাচ্ছে তার প্রতি লক্ষ্য না করে। চতুর্দিকে বাচ্চার ডাকাত, তাই সবাই ছুটেছে দিশেহারা হয়ে।
বাচ্চার প্রথম আক্রমণের দিনে শহরে যা দেখেছিলুম তার সঙ্গে এর তুলনা হয় না। সেদিনকার কাবুলী ভয় পেয়েছিল যেন বাঘের ডাক শুনে, এবারকার ত্রাস হঠাৎ বাঘের থাবার সামনে পড়ে যাবার। কেরানী সায়েব পেশাওয়ারের পাঠান। সাহসী বলে খ্যাতি আছে। তিনি পর্যন্ত আমাকে টেনে নিয়ে ছুটে চলেছেন— মুশকিল-আসানই জানেন কোন দিক দিয়ে। পাশ দিয়ে গা ঘেঁষে একটা ঘোড়া চলে গেল। নয়ানজুলিতে পড়তে পড়তে তাকিয়ে দেখি, ঘোড়-সওয়ারের পা জিনের পাদানে বেঁধে গিয়ে মাথা নিচের দিকে ঝুলছে আর ঘোড়ার প্রতি গ্যাপের সঙ্গে সঙ্গে মাথা রাস্তার শানে ঠোকর খাচ্ছে।
ততক্ষণে রাস্তার সুর-রিয়ালিস্টিক ছবিটার এলোপাতাড়ি দাগ আমার মনে কেমন যেন একটা আবছা আবছা অর্থ এনে দিয়েছে। কেরানী সায়েবের হাত থেকে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজেকে খালাস করে দাঁড়িয়ে গেলুম। ছবিটার যে জিনিস আমার অবচেতন মন ততক্ষণে লক্ষ্য করে একটা অর্থ খাড়া করেছে, সে হচ্ছে যে ডাকুরা কাউকে মারার মতলবে, কোনো কৎলে আম বা পাইকারি কচু-কাটার তালে নয়— তারা গুলী ছুঁড়ছে আকাশের দিকে। কেরানী সায়েবের দৃষ্টিও সেদিকে আকর্ষণ করলুম।
ততক্ষণে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে শুধু বাচ্চার ডাকাত দল, কেরানী সায়েব আর আমি; বাদবাকি নয়ানজুলিতে, দোকানের বারান্দায়, না হয় কাবুল নদীর শক্ত বরফের উপর উঁচু পাড়ির গা ঘেঁষে।
তিন চার মিনিট ধরে গুলী চলল— আমরা কানে আঙুল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। তারপর আবার সবাই এক একজন করে আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে এল। ডাকাতের দল ততক্ষণে হা হা করে হাসতে আরম্ভ করেছে তাদের শাদীয়ানা শুনে কাবুলের লোক এরকম ধারা ভয় পেয়ে গেল। কিসের শাদীয়ানা? জানোনা খবর, ইনায়েত উল্লা তখৎ ছেড়ে দিয়ে হাওয়াই জাহাজে করে হিন্দুস্থান চলে গিয়েছেন। তাই বাচ্চা থুড়ি বাদশাহ হবীব উল্লা খান হুকুম দিয়েছেন রাইফেল চালিয়ে শাদীয়ানা বা বিজয়োল্লাস প্রকাশ করার জন্য।