ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করলুম কিন্তু একটিমাত্র পরিচিত লোককে দেখতে পেলুম না। তখন ভালো করে লক্ষ্য করলুম যে, প্রায় সবাই দল বেঁধে চলছে, ভিখারী-আতুর ছাড়া একলাএকলি আর কেউ বেরোয়নি।
খাঁটী খবর দিতে পারে এমন একটি লোক পেলুম না। আভাসে আন্দাজে বুঝলুম, ইনায়েত উল্লা আর্কের ভিতর আশ্রয় নিয়ে দুর্গ বন্ধ করেছেন। আমান উল্লার কি পরিমাণ সৈন্য ইনায়েত উল্লার বশ্যতা স্বীকার করে দুর্গের ভিতরে আছে তার কোনো সন্ধান পেলুম না।
দোস্ত মুহম্মদ আমান উল্লার হয়ে লড়তে গিয়েছেন জানতুম, তাই একমাস ধরে তার বাড়ি বন্ধ ছিল। ভাবলুম এবার হয়ত ফিরেছেন, কিন্তু সেখানে গিয়েও নিরাশ হতে হল। বাড়ি ফিরে দেখি মৌলানা তখনো আসেননি, তাই পাকাপাকি খবরের সন্ধানে মীর আলমের বাড়ি গেলুম।
বুড়ো আবার সেই পুরোনো কথা দিয়ে আরম্ভ করলেন, যখন কোনো দরকার নেই তখন এই বিপজ্জনক অবস্থায় ঘোরাঘুরি করি কেন?
আমি বললুম, সামলে কথা বলবেন, স্যার। জানেন, বাদশা আমার পার্টনার। চাট্টিখানি কথা নয়। আপনার কি চাই বলুন, যা দরকার বাদশাকে বলে করিয়ে দেব।
মীর আসলম অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন। তারপর বললেন, ফার্সীতে একটা প্রবাদ আছে, জানো, রাজত্ববধূরে যেই করে আলিঙ্গন
তীক্ষ্ণ-ধার অসি পরে সে দেয় চুম্বন।
কিন্তু তোমার বাদশাহ অদ্ভুত! সাধারণ বাদশাহ কামানবন্দুক চালিয়ে অন্ততঃপক্ষে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে সিংহাসন দখল করে, তোমার বাদশাহ ইনায়েত উল্লা পিস্তলের ভয় পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে সিংহাসনের উপরে গিয়ে বসলেন।
আমি বললুম, কিন্তু দেখুন, শেষ পর্যন্ত সিংহাসনে যার হক ছিল তিনিই বাদশাহ হলেন। কাবুলের লোকজন তো আর ভুলে যায়নি যে, ইনায়েত উল্লা শহীদ বাদশাহ হবীব উল্লার বড় ছেলে।
মীর আসলম বললেন, সে কথা ঠিক কিন্তু হকের মাল এত দেরীতে পৌঁচেছে যে, এখন সে মালের উপর আরো পাঁচজনের নজর পড়ে গিয়েছে। শুনেছ বোধ হয় শোরবাজারের হজরত বাচ্চাকে ফেরাতে গিয়েছেন। তোমার কি মনে হয়?
আমি বললুম, ইনায়েত উল্লা তো আর কাফির নন। বাচ্চা ফিরে যাবে।
মীর আসলম বললেন, শোরবাজারের হজরতকে চেন না— তাই একথাটা বললে। তিনি আফগানিস্থানের সবচেয়ে বড় মোল্লা। আমান উল্লা বিদ্রোহের গোড়ার দিকেই তাকে জেলে পুরেছিলেন, সাহস সঞ্চয় করে ফঁসী দিতে পারেননি। আজ শোরবাজার স্বাধীন, কিন্তু ইনায়েত উল্লা বাদশাহ হলে তার কি লাভ? আজ
হয় তিনি বিপদে পড়ে শোরবাজারের হাতে-পায়ে ধরে তাকে দূত করে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাচ্চা যদি ফিরে যায় তবে দুদিন বাদে তাঁর শক্তি বাড়বে; সিংহাসনে কায়েম হয়ে বসার পর তিনি আর শোরবাজারের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। রাজার ছেলে রাজা হলেন, তিনি রাজত্ব চালাতে জানেন, শোরবাজারকে দিয়ে তাঁর কি প্রয়োজন?
পক্ষান্তরে বাচ্চা যদি ইনায়েত উল্লাকে তাড়িয়ে দিয়ে রাজা হতে পারে তবে তাতে শোরবাজারের লাভ। বাচ্চা ডাকাত, সে রাজ্যচালনার কি জানে? যে মোল্লাদের উৎসাহে বাচ্চা আজ লড়ছে সেই মোল্লাদের মুকুটমণি শোরবাজার তখন রাজ্যের কর্ণধার হবেন।
কিন্তু তারো চেয়ে বড় কারণ রয়েছে, বাচ্চা কেন ফিরে যাবে। তার যে-সব সঙ্গী-সাথীরা এই একমাস ধরে বরফের উপর কখনো দাঁড়িয়ে কখনো শুয়ে লড়ল, বাচ্চা তাদের শুধু হাতে বাড়ি ফেরাবে কি করে? কাবুল লুটের লালস দেখিয়েই তো বাচ্চা তাদের আপন ঝাণ্ডার তলায় জড়ো করেছে।
আমি বললুম, বাঃ! আপনিই তো সেদিন বললেন, বাচ্চা মহল্লা-সর্দারদের কথা দিয়েছে যে, কাবুলীরা যদি আমান উল্লার হয়ে পড়ে তবে সে কাবুল লুট করবে না।
মীর আসলম বললেন, এরই নাম রাজনীতি। ইংরেজ যেরকম লড়াইয়ের সময় আরবদের বলল তাদের প্যালেস্টাইন দেবে, ইহুদীদের বলল তাদেরও দেবে।
বাড়ি ফিরে এসে দেখি পাঞ্জাবী অধ্যাপকরা দল বেধে মৌলানাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসে আড্ডা জমিয়েছেন। আমাকে নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টা করলেন, কেউ বললেন, দাদা, আমার ছমাসের ছুটির প্রয়োজন, কেউ বললেন, পাঁচ বছর ধরে প্রোমোশন পাইনি, বাদশাহকে সেই কথাটা স্মরণ করিয়ে দেবেন। মৌলানা আমার হয়ে উত্তর দিয়ে বললেন, স্বপ্নেই যদি পোলাও খাবেন তবে ঘি ঢালতে কঞ্জুসি করছেন কেন? যা চাইবার দরাজ-দিলে চেয়ে নিন।
দেখলুম, এদের সকলেরই বিশ্বাস বাচ্চা শুধু-হাতে বাড়ি ফিরে যাবে আর কাবুলে ফের হারুন-অর-রশীদের রাজত্ব কায়েম হবে।
সন্ধ্যার দিকে আবদুর রহমান বুলেটিন ঝেড়ে গেল, বাচ্চা ফিরতে নারাজ, বলছে, যে-তাজ পাঁচজন আমাকে পরিয়েছেন, সে তাজ আমার শিরোধার্য। বুঝলুম, মীর আসলম ঠিকই বলেছেন, রাজা হওয়ার অর্থ সিংহের পিঠে সওয়ার হওয়া একবার চড়লে আর নামবার উপায় নেই।
সে রাত্রে বাড়িতে ডাকু হানা দিল। আবদুর রহমান তার রাইফেল ব্যবহার করতে পেয়ে যত না গুলী ছুড়ল তার চেয়ে আনন্দে লাফাল বেশী। ফিচকে ডাকাতই হবে, আবদুর রহমানের রণনাদ শুনে পালাল।
আবদুর রহমান তার বুলেটিনের মাল-মসলা সংগ্রহ করে দেউড়িতে দাঁড়িয়ে। রাস্তা দিয়ে যে যায় তাকেই ডেকে পই পই করে নানা রকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে–আমান উল্লা চলে যাওয়ায় তার শেষ ডর ভয় কেটে গিয়েছে। তবে এখন বাচ্চায়ে সকাও না বলে সম্মানভরে হবীব উল্লা খান বলে।
দুপুরবেলার বুলেটিনের খবর ইনায়েত উল্লা খান আর্ক দুর্গের ভিতর বসে আমান উল্লার কাছ থেকে সাহায্যের প্রতীক্ষা করছেন। বাচ্চা তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দিয়েছে। না হলে সে কাবুল শহরের কাউকে জ্যান্ত রাখবে না— ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেবে। ইনায়েত উল্লা উত্তর দিয়েছেন, কাবুলবাসীদের প্রচুর রাইফেল আর অপর্যাপ্ত বুলেট আছে, তাই দিয়ে তারা যদি আত্মরক্ষা না করতে পারে তবে এসব ভেড়ার পালের মরাই ভালো।