দুপুরবেলা মৌলানার ঘরে গিয়ে দেখি, কুরান পড়ে পড়ে তার চেহারা অনেকটা শান্ত হয়ে গিয়েছে। আসন্নপ্রসবা স্ত্রীর বিরহ ও তার সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা মন থেকে কেটে গিয়েছে।
কর্নেলের প্রতি আমার মনে শ্রদ্ধা জাগল। কোনো কোনো মানুষ মরে গিয়েও অন্যের মনে শান্তির উপলক্ষ্য হয়ে যান।
কিন্তু আমার মনে খেদও জেগে রইল। যে-মানুষটিকে পাঁচ মিনিটের জন্য চিনেছিলুম তাঁর মৃত্যুতে মনে হল যেন একটি শিশু-সন্তান অকালে মারা গেল। আমাদের পরিচয় তার পরিপূর্ণতা পেল না।
৩৮. আফগান প্রবাদ
আফগান প্রবাদ বাপ-মা যখন গদ গদ হয়ে বলেন, আমাদের ছেলে বড় হচ্ছে তখন একথা ভাবেন না যে, ছেলের বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও গোরের দিকে এগিয়ে চলেছেন। আমান উল্লা শুধু তার প্রিয় সংস্কার-কর্মের দিকেই নজর রেখেছিলেন, লক্ষ্য করেননি যে, সঙ্গে সঙ্গে তার রাজত্বের দিনও ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু শুধু আমান উল্লাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই তার উজিরনাজির সঙ্গী-সাথী ও রাস্তার আর পাঁচজন বাচ্চার পালিয়ে যাওয়াতে অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যাবার চেষ্টাতে ছিল।
বাচ্চার আক্রমণের ঠিক একমাস পরে— জানুয়ারীর কঠোর শীতের মাঝামাঝি একদিন শরীর খারাপ ছিল বলে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি, এমন সময় এক পাঞ্জাবী অধ্যাপক দেখা করতে এলেন। শহর তখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, দিনের বেলা চলাফেরা করাতে বিশেষ বিপদ নেই।
জিজ্ঞেস করলেন, খবর শুনেছেন?
আমি শুধালুম, কি খবর?
বললেন, তাহলে জানেন না, শুনুন। এরকম খবর আফগানিস্থানের মত দেশেও রোজ রোজ শোনা যায় না।
ভোরবেলা চাকর বলল, রাজপ্রাসাদে কিছু একটা হচ্ছে, শহরের বহুলোক সেদিকে যাচ্ছে। গিয়ে দেখি প্রাসাদে আফগানিস্থানের সব উজির, তাদের সহকারী, ফৌজের বড় বড় অফিসার এবং শহরের কয়েকজন মাতব্বর ব্যক্তিও উপস্থিত। সক্কলের মাঝখানে মুইন-উস-সুলতানে ইনায়েত উল্লা খান ও তার বড় ছেলে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখি যে, শহরের এত বড় মজলিসের মাঝখানে আমান উল্লা নেই। কাউকে জিজ্ঞেস করবার আগেই এক ভদ্রলোক খুব সম্ভব রইস-ই-শুরাই (প্রেসিডেন্ট অব দি কৌন্সিল) হবেন–একখানা ফরমান পড়তে আরম্ভ করলেন। দূরে ছিলুম বলে সব কথা স্পষ্ট শুনতে পাইনি; কিন্তু শেষের কথাগুলো পাঠক বেশ জোর দিয়ে চেঁচিয়ে পড়লেন বলে সন্দেহের কোন অবকাশ রইল না। আমান উল্লা সিংহাসন ত্যাগ করেছেন ও বড় ভাই মুইন-উস-সুলতানে ইনায়েত উল্লাকে সিংহাসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছেন।
আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলুম, হঠাৎ? কেন? কি হয়েছে?
শুনুন; ফরমান পড়া শেষ হলে কাবুলের এক মাতব্বর ব্যক্তি আফগানিস্থানের পক্ষ থেকে ইনায়েত উল্লাকে সিংহাসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। তখন ইনায়েত উল্লা অত্যন্ত শান্ত এবং নির্জীব কণ্ঠে যা বললেন, তার অর্থ মোটামুটি এই দাঁড়ায় যে, তিনি কখনও সিংহাসনের লোভ করেননি— দশ বৎসর পূর্বে যখন নসর উল্লা আমান উল্লায় রাজ্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, তখনও তিনি অযথা রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনা দেখে আপন অধিকার ত্যাগ করেছিলেন।
অধ্যাপক দম নিয়ে বললেন, তারপর ইনায়েত উল্লা যা বললেন সে অত্যন্ত খাঁটী কথা। বললেন, দেশের লোকের মঙ্গলচিন্তা করেই আমি একদিন ন্যায্য সিংহাসন গ্রহণ করিনি; আজ যদি দেশের লোক মনে করেন যে, আমি সিংহাসন গ্রহণ করলে দেশের মঙ্গল হবে তবে আমি শুধু সেই কারণেই সিংহাসন গ্রহণ করতে রাজী আছি।
আমি বললুম, কিন্তু আমান উল্লা?
অধ্যাপক বললেন, তখন খবর নিয়ে শুনলুম, আমান উল্লার ফৌজ কাল রাত্রে লড়াই হেরে গিয়ে পালিয়েছে। খবর ভোরের দিকে আমান উল্লার কাছে পৌঁছয়; তিনি তৎক্ষণাৎ ইনায়েত উল্লাকে ডেকে সিংহাসন নিতে আদেশ করেন। ইনায়েত নাকি অবস্থাটা বুঝে প্রথমটায় রাজী হননি— তখন নাকি আমান উল্লা তাঁকে পিস্তল তুলে ভয় দেখালে পর তিনি রাজী হন।
আমান উল্লা ভোরের দিকে মোটরে করে কান্দাহার রওয়ানা হয়েছেন। যাবার সময় ইনায়েত উল্লাকে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন, পিতৃপিতামহের দুরূরানী ভূমি কান্দাহার তাকে নিরাশ করবে না। তিনি শীঘ্রই ইনায়েত উল্লাকে সাহায্য করার জন্য সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হবেন।
আমান উল্লা তাহলে শেষ পর্যন্ত পালালেন। চুপ করে অবস্থাটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করতে লাগলুম।
অধ্যাপক হেসে বললেন, আপনি তো টেনিস খেলায় ইনায়েত উল্লার পার্টনার হন। শুনেছি, তিনি তাঁর বিরাট বপু নাড়াচাড়া করতে পারেন না বলে আপনি কোর্টের বারাআনা জমি সামলান— এইবার আপনি আফগানিস্থানের বাবোআনা না হোক অন্তত দুচারআনা চেয়ে নিন।
আমি বললুম, তাতো বটেই। কিন্তু বাচ্চার বুলেটের অন্তত দুচারআনা ঠেকাবার ভার তাহলে আমার উপর পড়বে না তো?
অধ্যাপক বললেন, তওবা, তওবা। বাচ্চা এখন আর লড়বে কেন, বলুন। তার কাছে ইত্যবসরে শোরবাজারের হজরত আর সর্দার ওসমান খান ইনায়েত উল্লার পক্ষ থেকে খবর নিয়ে গিয়েছেন যে, কাফির আমান উল্লা যখন সিংহাসন ত্যাগ করে পালিয়েছে তখন আর যুদ্ধ বিগ্রহ করার কোনো অর্থ হয় না। বাচ্চা যেন বাড়ি ফিরে যান তার সঙ্গে ইনায়েত উল্লার কোনো শত্রুতা নেই।
অধ্যাপক চলে গেলে পর আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর্কের দিকে চললুম।।
এবারে শহরের দৃশ্য আরো অদ্ভুত। বাচ্চার প্রথম ধাক্কার পর তবু কাবুল শহরে রাজা ছিলেন, তিনি দুর্বল না সবল সাধারণ লোকে জানত না বলে রাজদণ্ডের মর্যাদা তখন কিছু কিছু ছিল কিন্তু এখন যেন আকাশেবাতাসে অরাজকতার বিজয়লাঞ্ছন অঙ্কিত। যারা রাস্তা দিয়ে চলেছে তারা স্পষ্টত কাবুলবাসিন্দা নয়। তাদের চোখে মুখে হত্যালুণ্ঠনের প্রতীক্ষা আর লুক্কায়িত নয়। এরা সব দল বেঁধে চলেছে— কেউ কোথাও একবার আরম্ভ করলে এদের আর ঠেকানো যাবে না।