অধ্যাপক শুধালেন, কিন্তু রামচন্দরজী জবরদস্ত লড়নেওয়ালা ছিলেন, নয় কি?
আমি বললুম, আলবৎ।
অধ্যাপক বললেন, ঐ তো হল আসল তত্ত্বকথা। বীরপুরুষ আর বীরের জামাত্রই ভাইকে অত্যন্ত গভীর ভাবে ভালবাসে। পাঠানদের মত বীরের জাত কোথায় পাবেন বলুন?
আমি বললুম, কিন্তু অধ্যাপক খুদাবখশ তো বীরপুরুষ ছিলেন না।
অধ্যাপক পরম পরিতৃপ্তি সহকারে বললেন, সেই তো গুহতর তত্ত্ব। অধ্যাপকি করো আর যাই করো, পাঠান যাবে কোখেকে? অর্থনৈতিক কারণ-ফারণ সব কিছুই অত্যন্ত পাতলা ফিলিম একটু খোঁচা লাগলেই আসল পেলে বেরিয়ে পড়ে।
মেজর মুহম্মদ খান বললেন, ভাইকে ভালোবাসার জন্য পাঠান হওয়ার কি প্রয়োজন? ইউসুফও (জোসেফ) তো বেনয়ামিনকে (বেনজামিন) ভয়ঙ্কর ভালবাসতেন।
অধ্যাপক বললেন, ইহুদিদের কথা বাদ দিন। আদমের এক ছেলে আরেক ছেলেকে খুন করেনি?
আমি বললুম, কিন্তু পাঠানরা ইহুদিদের হারিয়ে-যাওয়া বারো উপজাতির একটা নয়? কোথায় যেন ঐ রকম একটা থিয়োরি শুনেছি যে সেই উপজাতি যখন দেখল তাদের কপালে শুকনো, মরা আফগানিস্থান পড়েছে তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল–অর্থাৎ ফারসীতে যাকে বলে ফগান করেছিল— তাই তো তাদের নাম আফগান। আর আপনারা তো আসলে আফগান, এদেশে বসবাস করে হিন্দুস্থানী হয়েছেন।
অধ্যাপক পণ্ডিতের হাসি হেসে বললেন, ত্রিশ বৎসর আগে এ কথা বললে আপনাকে আমরা সাবাসী দিতুম, এখন ওসব বদলে গিয়েছে। তখন আমরা জানতুম না যে, দুনিয়ার বড় বড় জাতেরা নিজেদের আর্য বলে গৌরব অনুভব করছে। তখনো রেওয়াজ ছিল খানদানী হতে হলে বাইবেলের ইহুদি চিড়িয়াখানায় কোনো না কোনো খাঁচায় সিংহ বাঁদর কিছু না কিছু একটা হতেই হবে। এখন সে সব দিন গিয়েছে। এখন আমরা সব্বাই আর্য। বেদফেদ কি সব আছে?— সেগুলো সব আমরাই আউড়েছি। সিকন্দর শাহকে লড়াইয়ে আমরাই হারিয়েছি আর গান্ধার ভাস্কর্য আমাদেরই কাঁচা বয়সের হাত মহল্লার নমুনা। গান্ধার আর কান্দাহার একই শব্দ। আরবী ভাষায় গ অক্ষর নেই বলে আরব ভৌগোলিকেরা ক ব্যবহার করেছেন।
পাণ্ডিত্যের অগাধ সাগরে তখন আমার প্রাণ যায় যায়। কিন্তু বিপদ-আপদে মুস্কিল-আসান হামেশাই পুলিশ। আহমদ আলী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রফেসরের ওসব কথা গায়ে মাখবেন না। ইসলামিয়া কলেজের চায়ের ঘরে যে আড্ডা জমে তারি খানিকটে পেতলে নিয়ে তিনি সুন্দর ভাষায় রঙীন গেলাসে আপনাকে ঢেলে দিচ্ছেন। কিন্তু আসল পাঠান এসব জিনিস নিয়ে কখনো মাথা ঘামিয়ে পাগড়ির প্যাঁচ ঢিলে করে না। আফ্রিদী ভাবে, আফ্রিদী হল দুনিয়ার সেরা জাত; মোমন্দ বলে বাজে কথা, খুদাতালার খাস পেয়ারা কোনো জাত যদি দুনিয়ায় থাকে তবে সে হচ্ছে মোমন জাত। এমন কি, তারা নিজেদের আফগান বলেও স্বীকার করে না।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তাই বুঝি আপনারা স্বাধীন আফগানিস্থানের অংশ হতে চান না? ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে, স্বাধীন পাঠান হয়ে থাকবেন বলে?
সব পাঠান এক সঙ্গে চেঁচিয়ে বললেন, আলবৎ না; আমরা স্বাধীন ফ্রন্টিয়ার হয়ে থাকব সে মুল্লুকের নাম হবে পাঠানমুলুক।
অধ্যাপক বললেন, পাঠানের সোপবক্স লেকচার শোনেননি বুঝি কখনো। সে বলে, ভাই পাঠানস, এস আমরা সব উড়িয়ে দি; ডিমোক্রসি, অটোক্রেসি, বুরোক্রেসি, কমুনিজম, ডিটেটরশিপ— সব সব। আরেক পাঠান তখন চেঁচিয়ে বলল, তুই বুঝি অ্যানার্কিস্ট পাঠান বলল, না, আমরা অ্যানার্কিও উড়িয়ে দেব।
অধ্যাপক বললেন, বুঝতে পেরেছেন?
আমি বললুম, বিলক্ষণ, রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, একেবারে বুদ হয়ে যাবে, ঝিম হয়ে যাবে, তো হয়ে যাবে, তারপর না হয়ে যাবে। এই তো?
অধ্যাপক বললেন, ঠিক ধরেছেন।
আমি বললুম, ভারতবর্ষের অংশ যখন হবেন না, তখন দয়া করে রাশানদের আপনারাই ঠেকিয়ে রাখবেন।
সবাই সমস্বরে বললেন, আলবৎ।
০৬. আফগানিস্থান যেতে হলে
পৃথিবীর আর সব দেশে যেতে হলে একখানা পাসপোর্ট যোগাড় করে যে কোনো বন্দরে গিয়ে হাজির হলেই হল। আফগানিস্থান যেতে হলে সেটি হবার যো নেই। পেশাওয়ার পৌঁছে আবার নূতন স্ট্যাম্পের প্রয়োজন। সে-ও আবার তিন দিন পরে নাকচ হয়ে যায়। খাইবারপাসের আশেপাশে কখন যে দাঙ্গাহাঙ্গামা লেগে যায় তার স্থিরতা নেই বলেই এই বন্দোবস্ত। আবার এই তিন দিনের মিয়াদি স্ট্যাম্প সত্ত্বেও হয়ত খাইবারের মুখ থেকে মোটর ফিরিয়ে দিতে পারে যদি ইতিমধ্যে কোনো বখেড়া লেগে গিয়ে থাকে।
সেই স্ট্যাম্প নিয়ে বাড়ি ফিরছি এমন সময় দেখি হরেক রকম বিদেশী লোকে ভর্তি কতকগুলো বা পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। আহমদ আলীকে জিজ্ঞাসা করলুম, এগুলো কোথায় যাচ্ছে?
তিনি ধমক দিয়ে বললেন, এগুলো কাবুল যায় না। তারপর অন্য কথা পাড়বার জন্য বললেন, বাঙলা দেশের একটা গল্প বলুন না।
আমি মনে মনে বললুম, আচ্ছা তবে শোন। বাইরে বললুম, গল্প বলা আমার আসে না, তবে একটা জিনিসে পাঠানে বাঙালীতে মিল দেখতে পেয়েছি সেইটে আপনাকে বলছি, শুনুন
এখানে যে রকম সব কারবার পাঞ্জাবী আর শিখদের হাতে কলকাতায়ও কারবার বেশীর ভাগ অ-বাঙালীর হাতে। আর বাঙালী যখন ব্যবসা করে তখন তার কায়দাও আজব।
আমি তখন ইলিয়ট রোডে থাকতুম, সেখানে দোকানপাট ফিরিঙ্গীদের। মুসলমানদের কিছু কিছু দর্জীর দোকান আর লণ্ডি, ব্যস। তার মাঝখানে এক বাঙালী মুসলমান ঝা চকচকে ফ্যান্সি দোকান খুলল। লোকটির বেশভূষা দেখে মনে হল, শিক্ষিত, ভদ্রলোকের ছেলে। স্থির করলুম, সাহস করে দোকান যখন খুলেছে তখন তাকে পেট্রনাইজ করতে হবে।