আমান উল্লার সেই চরম দুর্দিনে সব বিদেশীর মধ্যে একমাত্র বলশফের কর্তৃত্বে রাশান পাইলটরাই তাকে সাহায্য করেছিল। বাচ্চা জিতলে তাদের কি অবস্থা হবে সে সম্বন্ধে একদম পরোয়া না করে।
দিন পনরো পরে খবর পেলুম, অ্যারোপ্লেন কাবুল থেকে বিদেশী সব স্ত্রীলোক কাচ্চা-বাচ্চা ঝেঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছে; বিদেশী বলতে এখন বাকি শুধু ভারতীয়। তিন লক্ষে ব্রিটিশ লিগেশনে উপস্থিত হয়ে মৌলানার বউয়ের কথাটা সকাতর সবিনয় নিবেদন করলুম। ব্রিটিশের দয়া অসীম। ভারতবাসিনী-লাদাই উড়ো-জাহাজের প্রথম ক্ষেপেই তিনি স্থান পেলেন। পুনরপি তিন লক্ষ্যে বাড়ি পৌঁছে আঙিনা থেকেই চিৎকার করে বললুম, মৌলানা, কেল্লা ফতেহ, সীট পেয়ে গিয়েছি। বউকে বলো তৈরী হতে। এখন ওজন করাতে নিয়ে যেতে হবে, কর্তারা ওজন জানতে চান।
মৌলানা নিরুত্তর। আমি অবাক। শেষটায় বললেন যে, তাঁর বউ নাকি একা যেতে রাজী নন, বলছেন, মরবার হলে এদেশে স্বামীর সঙ্গেই মরবেন। আমি শুধালুম, তুমি কি বলছ? মৌলানা নিরুত্তর। আমি বললুম, দেখ মৌলানা, তুমি পাঞ্জাবী, কিন্তু শান্তিনিকেতনে থেকে থেকে আর গুরুদেবের মোলায়েম গান গেয়ে গেয়ে তুমি বাঙালীর মত মোলায়েম হয়ে গিয়েছ। বাধি যে রাখি-টাখি এখন বাদ দাও। মৌলানা তবু নিরুত্তর। চটে গিয়ে বললুম, তুমি হিন্দু হয়ে গিয়েছ, তাও আবার ১৮১০ সালের সতীদাহে বিশ্বাস করে। কিন্তু জানো, যে গুরুদেবের নাম শুনে অজ্ঞান হও, তাঁরই ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ঠাকুর টাকা দিয়ে সতীদাহের বিরুদ্ধে বিলেতে মোকদ্দমা লড়িয়েছিলেন। মৌলানা নিরুত্তর। এবারে বললুম, শোনো ব্রাদার, এখন ঠাট্টামস্করার সময় নয়, কিন্তু ভেবে দেখো, তোমার বউয়ের কবে বাচ্চা হবে, তার হিসেব-টিসেব রাখোনি না হয় বদ্যি পেলুম, ধাই পেলুম, কিন্তু যদি বাচ্চা হওয়ার পর তোমার বউয়ের বার তিনেক গলা খাঁকারি দিয়ে বললুম–তাহলে আমি দুধ যোগাড় করব কোথা থেকে? বাজারে ফের কবে দুধ উঠবে, তার তো কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
মৌলানা বউয়ের কাছে গেলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অল্প অল্প কান্নার শব্দ শুনতে পেলুম। মৌলানা বেরিয়ে এসে বললেন, রাজী হচ্ছেন না।
তখন মৌলানাকে বাইরে রেখে ভিতরে গেলুম। বললুম, আপনি যে মৌলানাকে ছেড়ে যেতে চাইছেন না, তার কারণ যে আমি বুঝতে পারছিনে তা নয়; কিন্তু ভেবে দেখুন তো, আপনার
যাওয়াতে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? আপনি যদি চলে যান, তবে তিনি যেখানে খুশী কোনো ভাল জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারবেন। শুধু তাই নয়, অবস্থা যদি আরো খারাপ হয়, তবে হয়ত তাঁকেও এদেশ ছাড়তে হবে। আপনি না থাকলে তখন তার পক্ষে সব কিছুই অনেক সহজ হয়ে যাবে। এসব কথা তিনি আপনাকে কিছুই বলেননি, কারণ এখন তিনি নিজের কথা আদপেই ভাবছেন না, ভাবছেন শুধু আপনার মঙ্গলের কথা। আপনি তার স্ত্রী, আপনার কি এদিকে খেয়াল করা উচিত নয়?
ওকালতি করছি আর ভাবছি মৌলানার যদি ছেলে হয়, তবে তাকে ব্যারিস্টারি পড়াব। মেয়ে হলে আমান উল্লার মায়ের হাতে সঁপে দেব।।
ওষুধ ধরল। ভারত নারীর শ্মশানচিকিৎসা স্বামীর স্বার্থের দোহাই পাড়া।
পরদিন সকাল বেলা মৌলানা বউকে নিয়ে অ্যারোডড্রামে গেলেন। বিপদ-আপদ হলে আবদুর রহমানের কাঁধ কাজে লাগবে বলে সেও সঙ্গে গেল। আমি রইলুম বাড়ি পাহারা দিতে। দিন পরিষ্কার ছিল বলে ছাতে দাঁড়িয়ে দেখলুম, পুব থেকে প্রকাণ্ড ভিকা বমার এল, নামল, ফের পুব দিকে চলে গেল। মাটিতে আধ ঘণ্টার বেশী দাঁড়ায়নি কাবুল নিরাপদ স্থান নয়।
জিয়াউদ্দীন ফিরে এসে মুখ ঝামর করে উপরে চলে গেলেন। আবদুর রহমান বলল, মৌলানা সাহেবের বিবির জামা-কাপড় দেখে পাইলট বলল যে, অ্যারোপ্লেন যখন আসমানে অনেক উপরে উঠবে, তখন ঠাণ্ডায় তার পা জমে যাবে। তাই বোধ হয় তারা সঙ্গে খড় এনেছিল— মৌলানা সাহেব সেই খড় দিয়ে তাঁর বিবির দুপা বেশ করে পেঁচিয়ে দিলেন। দেখে মনে হল যেন খড়ে জড়ানো বিলিতী সিরকার বোতল। সব মেয়েদেরই পা এরকম কায়দায় সফর-দুরুস্ত করতে হল।
আমরা দেউড়িতে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছিলুম। এমন সময় আমাদের সামনে দিয়ে একটা মড়া নিয়ে কয়েকজন লোক চলে যাচ্ছে দেখে আবদুর রহমান হঠাৎ কথাবার্তা বন্ধ করে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। ভারবাহীরা আমার প্রতিবেশী কর্নেলের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আবদুর রহমান কড়া নাড়ল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ, আর্ত ক্রন্দনধ্বনি যেন তীরের মত বাতাস ছিঁড়ে আমার কানে এসে পৌঁছল— মড়া দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢাকাতে যতক্ষণ সময় লাগল, ততক্ষণ গলার পর গলা সে আর্তনাদে যোগ দিতে লাগল। চিৎকারে চিৎকারে মানুষের বেদনা যেন সপ্তম স্বর্গে ভগবানের পায়ের কাছে পৌঁছতে চাইছে।
কান্না যেন হঠাৎ কেউ গলা টিপে বন্ধ করে দিল— মড়া বাড়িতে ঢোকানো হয়েছে, দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই নিস্তব্ধতা তখন যেন আমাকে কান্নার চেয়ে আরো বেশী অভিভূত করে ফেলল। আমি ছুটে গিয়ে মৌলানার ঘরে ঢুকলুম। আবদুর রহমান এসে খবর দিল, কর্নেল লড়াইয়ে মারা গিয়েছেন।
মৌলানা দুহাত তুলে দোয়া পড়তে আরম্ভ করলেন। আবদুর রহমান আর আমি যোগ দিলুম। দোয়া শেষে মৌলানা বললেন, লড়াইয়ে যাওয়ার আগে কর্নেল আমাদের দোয়া মাঙতে এসে ছিলেন, আমাদের উপর এখন তার হক আছে। তারপর মৌলানা ওজু করে কুরান শরীফ পড়তে আরম্ভ করলেন।