বাড়াবাড়ি করছি? মোটেই না। ধান ভানতে শিবের গীত? তাও নয়। বিপ্লব-বিদ্রোহ রক্তপাত-রাহাজানি মাত্রই রুদ্রের তাণ্ডব নৃত্য–এতক্ষণ সে কথাই হচ্ছিল, এখন তার নন্দীভৃঙ্গী-সম্বাদের পালা।
ইংরেজের এই আভিজাত্য, এই স্নবারি ছাড়া অন্য কোনো কিছু দিয়ে ব্রিটিশ রাজদূতের মনোবৃত্তির যুক্তিযুক্ত অর্থ করা যায় না। ব্রিটিশ লিগেশনের যা আকার তাতে কাবুলের বাদবাকি সব কটা রাজদূতাবাস অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে। একখানা ছোটখাট শহর বললেও অত্যুক্তি হয় না নিজের জলের কল, ইলেকটিক পাওয়ার-হৌস, এমন কি ফায়ার-ব্রিগেড পর্যন্ত মৌজুদ। শীতকালে সায়েব-সুবোদের খেলাধুলোর জন্য চা-বাগানের পাতাশুকোবার ঘরের মত যে প্রকাণ্ড বাড়ি থাকে তারই ভিতরে সমস্ত ভারতীয় আশ্রয়প্রার্থীনীর জায়গা হতে পারত। আহারাদি? ব্রিটিশ লিগেশন কাবুল থেকে পালিয়ে আসার সময় যে টিনের খাদ্য ফেলে এসেছিল তাই দিয়ে মেয়েদের পাকা ছমাস চলতে পারত।
ফ্রেঞ্চ লিগেশনের যে মিনিস্টারকে বেনওয়া সায়েব রসিকতা করে সিনিস্টার অব দি ফ্রেঞ্চ নিগেশন বলতেন তিনি পর্যন্ত আশ্রয়প্রার্থী ফরাসীদের মন চাঙ্গা করার জন্য ভাণ্ডার উজাড় করে শ্যাম্পেন খাইয়েছিলেন।
ডাক্তার আসে না, অন্ন জুটছে না, পথ্যের অভাব, দাই নেই, আসন্নপ্রসবার আশ্রয় জুটছে না; তাকে ফেলে রেখে ভারতীয় পয়সায় কেনা হাওয়াই জাহাজ ভারতবর্ষে যাচ্ছে ইংরেজ, ফরাসী, জর্মন, সকল জাতের মেম সায়েবদের নিয়ে! হে দ্রৌপদীশরণ, চক্ৰধারণ, এ দ্রৌপদী যে অন্তঃসত্ত্বা।
উত্তরদিকে থেকে কাবুল শহর আক্রমণ করতে হলে ব্রিটিশ রাজদূতাবাস অতিক্রম করে আরো এক মাইল ফঁকা জায়গা পেরতে হয়। বাচ্চা তাই করে শহর-আরা হস্টেলে পৌঁচেছিল। সুবে আফগানিস্থান জানে সে সময় পাকা চারদিন ব্রিটিশ রাজদূতাবাস তথা মহামান্য স্যার ফ্রান্সিসের জীবন বাচ্চার হাতের তেলোয় পুটি মাছের মত এক গণ্ডুষ জলে খাবি খাচ্ছিল। বাচ্চা ইচ্ছে করলেই যে কোনো মুহূর্তে সমস্ত লিগেশনকে কচুকাটা করতে পারত— একটু ঔদাসীন্য দেখালেই তার উদগ্রীব সঙ্গীরা সবাইকে কতল করে বাদশাহী লুট পেত, কিন্তু জলকরবাহীর তস্করপুত্র অভিজাততনয়ের প্রাণ দান করল। তবু দ্যদত্ত করুণাল সে-প্রাণ বিপন্ন নারীর দুঃখে বিগলিত হল না।।
গল্প শুনেছি, জর্জ ওয়াশিংটন তার নাতিকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। পথে এক নিগ্রো হ্যাট তুলে দুজনকে নমস্কার করল। ওয়াশিংটন হ্যাট তুলে প্রতিনমস্কার করলেন, কিন্তু নাতি নিগ্রোকে তাচ্ছিল্য করে নমস্কার গ্রহণ করল না। জর্জ ওয়াশিংটন নাতিকে বললেন, নগণ্য নিগ্রো তোমাকে ভদ্রতায় হার মানালো।
দয়া দাক্ষিণ্যে, করুণা ধর্মে মহামান্য সম্রাটের অতিমান্য প্রতিভূ হিজ একসেলেন্সি লেফটেনেন্ট কর্নেল স্যার ফ্রান্সিসকে হার মানালো ডাকুর বাচ্চা!
চিরকুট পেলুম, দেমিদফ লিখেছেন রাশান এম্বেসিতে যেতে। এ রকম চিঠি আর কখনো পাইনি, কারণ কোন কিছুর দরকার হলে তিনি নিজেই আমার বাড়িতে উপস্থিত হতেন।
চেহারা দেখেই বুঝলুম কিছু একটা হয়েছে। দোরের গোড়াতেই বললুম, কি হয়েছে, বলুন। দেমিদফ কোনো উত্তর না দিয়ে আমাকে ঘরে এনে বসালেন। মুখোমুখি হয়ে বসে দুহাত দুজানুর উপর রেখে সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলশফ মারা গিয়েছেন।
আমি বললুম, কি?
দেমিদফ বললেন, আপনি জানতেন যে, বিদ্রোহ আরম্ভ হতেই বলশফ নিজের থেকে আমান উল্লার কাছে উপস্থিত হয়ে বাচ্চায়ে সকাওয়ের দলের উপর অ্যারোপ্লেন থেকে বোমা ফেলার প্রস্তাব করেন। কাল বিকেলে–
আমি ভাবছি, বলশফ কিছুতেই মরতে পারে না, অবিশ্বাস্য।
–কাল বিকেলে অন্য দিনের মত বোমা ফেলে এসে এম্বেসির ক্লাব ঘরে দাবা খেলতে বসেছিলেন। ব্রিচেসের পকেটে ছোট্ট একটি পিস্তল ছিল; বাঁ হাত দিয়ে ঘুটি চালাচ্ছিলেন, ডান হাত পকেটে রেখে পিস্তলের ঘোড়াটা নিয়ে খেলা করছিলেন, জানেন তো, বলশফের স্বভাব, কিছু একটা নাড়াচাড়া না করে বসতে পারতেন না। হঠাৎ টি গারে একটু বেশী চাপ পড়াতেই গুলী পেটের ভিতর দিয়ে হৃৎপিণ্ডের কাছ পর্যন্ত চলে যায়। ঘণ্টা ছয়েক বেঁচে ছিলেন, ডাক্তার কিছু করতে পারলেন না।
আমার তখনও কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না বলশফের মত বটগাছ কি করে বিনা ঝড়ে পড়ে যেতে পারে। এত লড়াই লড়ে, এত জখম কাটিয়ে উঠে শেষে নিজের হাতে?
দেমিদফ বললেন, আপনার খুব লাগবে আমি জানতুম তাই সংক্ষেপে বললুম; আর যদি কিছু জানতে চান–? আমি বললুম, না।
চলুন, দেখতে যাবেন।
আমি বললুম, না। বাড়ি যাবার জন্য উঠলুম। মাদাম তাড়াতাড়ি আমার সামনে পথ বন্ধ করে বললেন, এখানে খেয়ে যান।
আমি বললুম, না।
টেনিস কোর্টের পাশ দিয়ে বেরবার সময় হঠাৎ যেন শুনতে পেলুম বলশফের গলা, জাসভুইয়িতে, মই প্রিয়াতেল–এই যে বন্ধু, কি রকম? চমকে উঠলুম। আমার মন তখনো বিশ্বাস করছে না, বলশফ নেই। এই টেনিস কোর্টেই তার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল আর এই যে দেউড়ি দিয়ে বেরচ্ছি এরই ভিতর দিয়ে কতবার তার সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছি।
বাড়ি এসে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার অজানাতে মন সমস্ত রাত বলশফের কথা ভেবেছে। ঘুম ভাঙতে যেন শুধু সচেতন হলুম। মনে পড়ল তার সঙ্গে শেষ কথাবার্তা। ঠাট্টা করে বলেছিলুম, বলশফ তুমি আমান উল্লার হয়ে লড়ছ কেন? আমান উল্লা রাজা, বাচ্চার দল প্রলেতারিয়েস্ট অব দি প্রলেতারিয়া। তোমার উচিত বাচ্চার দলে যোগ দিয়ে লড়া। বলশফ বলেছিল, বাচ্চা কি করে প্রলেতারিয়া হল? সেও তো রাজার মুকুট পরে এসেছে। রাজায় রাজায় লড়াই। এক রাজা প্রগতিপন্থী, আরেক রাজা প্রগতির শত্রু। চিরকাল প্রগতির জন্য লড়েছি, এখনো লড়ছি, তা সে এৎস্কির নেতৃত্বেই হোক আর আমান উল্লার আদেশেই হোক।