ভাবলুম মীর আসলমকে এ-খবরটা দিলে তিনি খুশী হবেন। বুড়ো উল্টে গম্ভীর হয়ে বললেন, সমরকন্দ-বুখারার মুসলিমদের উচিত রুশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। রুশ সরকার তাদের মক্কায় হজ করতে যেতে দেয় না।
খামখেয়ালি ঘোটলাটের আশু আগমন সংবাদ শুনে যে রকম গাঁয়ের পণ্ডিত হতবুদ্ধি হয়ে যান, মৌলানা আর আমি সেই রকম একে অন্যের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাই। মৌলানার বউ যে-বড়লাটকে নিমন্ত্রণ করে বসে আছেন, তিনি কোন্ দিন কোন্ গাড়িতে কি কায়দায় আসবেন, তাঁকে কে অভ্যর্থনা করবেন, তিনি এলে তাকে কোথায় রাখতে হবে, কি খাওয়াতে পরাতে হবে, সে সম্বন্ধে কোনো প্রকারের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবার সুযোগ আমাদের কারো হয়নি–মৌলানার বউও কিছুই জানেন না; তার এই প্রথম বাচ্চা হচ্ছে।
শুনেছি আফগান মেয়েরা ক্ষেতের কাজ খানিকক্ষণের জন্য ক্ষান্ত দিয়ে গাছের আড়ালে গিয়ে সন্তান প্রসব করে আসন্ন প্রসবার জন্য আফগান পণ্যবাহিনীও নাকি প্রতীক্ষা করে না। সে নাকি বাচ্চা কোলে করে একটু পা চালিয়ে পণ্যবাহিনীতে আবার যোগ দেয়। মৌলানার বউ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে; তার কাছ থেকে এরকম কসরৎ আশা করা অন্যায়। লক্ষণ দেখেও আমরা ঘাবড়ে গেলুম। কিছু খেতে পারেন না, রাত্তিরে ঘুম হয় না, সমস্ত দিন টুলটুল চোখ, মৌলানাকে এক মিনিটের তরে সেই ঢুলুঢুলু চোখের আড়াল হতে দেন না।
অন্যের প্রাণহরণ করা ব্যবসা হলেও নিজের প্রাণ দেবার বেলা সব মানুষের একই আচরণ। ডাক্তার কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরতে রাজী হয় না। সেদিন তাকে যা সাধ্যসাধনা করেছিলুম, তার অর্ধেক তোষামোদে কালো ভঙ্গজ মেয়ের জন্য বিনাপণে নিকষি নটবর বর মেলে। বাড়ি ফেরবার সময় সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম যে, মৌলানার যদি ছেলে হয়, তবে তাকে ডাক্তারি পড়াব শোনবৈরাগ্যের মত এ হল শোনপ্রতিজ্ঞা।
সিভিল সার্জন যে রকম গরীব রোগীর অর্থসামর্থ্যের প্রতি ক্ষেপ না করে আড়াই গজী প্রেসক্রিপশন্ ঝেড়ে যান, কাবুলী ডাক্তার তেমনি পথ্যির ফিরিস্তি আউড়ে গেলেন। শুনে ভয় পেয়ে মৌলানা আর আমি খাটের তলায় আশ্রয় নিলুম। চারদিন ধরে খাচ্ছি রুটি, দাল আর বিন-দুধ চা–এ দুর্দিনে স্বয়ং আমান উল্লা ওসব ফেন্সি পথ্যি যোগাড় করতে পারবেন না। দুধ! আঙুর!! ডিম!!! বলে কি? পাগল, না মাথা-খারাপ?
আবদুর রহমান সবিনয় নিবেদন করল, সন্ধ্যার সময় তাকে একটা রাইফেল আর দুঘণ্টার ছুটি দিলে সে চেষ্টা করে দেখতে রাজী আছে। ডাকাতিতে আমার মরাল অবজেকশন নেইযস্মিন দেশাচার, তদুপরি প্রবাসে নিয়ম নাস্তি–কিন্তু সব সময় সব ডাকাত তো আর বাড়ি ফেরে না। যদি আবদুর রহমান বাড়ি না ফেরে। তবে বাড়ি অচল হয়ে যাবে।
এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি বাচ্চায়ে সকাও যেন ডাক্তারের বেশ পরে তিস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে করে আমাকে বলছে, হয় দাও আঙুর, না হয় নেব মাথা।
৩৭. দৈনিক বুলেটিন
চারদিনের দিন আবদুর রহমান তার দৈনিক বুলেটিনের এক বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে খবর জানালো, বাচ্চা মাইল দশেক হটে গিয়েছে। দিন দশেকের ভিতর শহরের ইস্কুল-কলেজ, আপিসআদালত খুলল।
আমান উল্লা দম ফেলবার ফুরসত পেলেন।
কিন্তু বাচ্চাকে তাড়াতে পেরেও তিনি ভিতরে ভিতরে হার মেনেছেন। দেরেশির আইন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে, মেয়ে স্কুল বন্ধ করা হয়েছে আর রাস্তা-ঘাট থেকে ফ্রক-রাউজ সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। যে সব মেয়েরা এখন রাস্তায় বেরন তারা পরেন সেই তাম্বু ধরনের বোরকা। হ্যাট পরার সাহস আর পুরুষস্ত্রীলোক কারো নেই–হয় পাগড়ি, নয় পশমের টুপি। যেসব স্কুলকলেজের ছাত্রেরা এই ডামাডোলের বাজারে পালিয়েছিল তাদের ধরে আনবার কোনো চেষ্টা করা হল না করার উপায়ও ছিল না কারণ পুলিশের দল তখনো ফেরার, আসামী ধরবে কে?
মৌলানা বললেন, সবশুদ্ধ মিলিয়ে দেখলে বলতে হবে ভালোই হয়েছে। আমান উল্লা যদি এ যাত্রা বেঁচে যান তবে বুঝতে পারবেন যে দেরেশি চাপানো, পর্দা তুলে দেওয়া আর বৃহস্পতিবারে ছুটির দিন করা এই অনুন্নত দেশের সব চেয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার নয়। বাকি রইল শিক্ষাবিস্তার আর শিল্পবাণিজ্যের প্রসার এবং এ দুটোর বিরুদ্ধে এখনো কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। বিপদ কাটার পর আমান উল্লা যদি এই দুটো নিয়ে লেগে যান তবে আর সব আপনার থেকেই হয়ে যাবে।
মীর আসলম এসে বললেন, অবস্থা দেখে বিশেষ ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। শিনওয়ারীরা এখনো মারমুখো হয়ে আছে। আমান উল্লার সঙ্গে তাদের সন্ধির কথাবার্তা চলছে। তার ভিতরে দুটো শর্ত হচ্ছে, তুর্কী থেকে কাবুলী মেয়ে ফিরিয়ে আনা আর রানী সুরাইয়াকে তালাক দেওয়া। রানী নাকি বিদেশে পরপুরুষের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করে মান-ইজ্জৎ খুইয়ে এসেছেন।
আমরা বললুম, সে কি কথা? সমস্ত পৃথিবীর কোথাও তো রানী সুরাইয়া সম্বন্ধে এ রকম বদনাম রটেনি। ভারতবর্ষের লোক পর্দা মানে, তারা পর্যন্ত রানী সুরাইয়ার প্রশংসা ভিন্ন নিন্দা করেনি। শিনওয়ারীরা এ আজগুবি খবর পেলে কোথেকে আর রটাচ্ছে কোন লজ্জায়।
মীর আসলম বললেন, শিনওয়ারী মেয়েরা বিনা পর্দায় খেতের কাজ করে বটে কিন্তু পরপুরুষের দিকে আড়নয়নে তাকালেও তাদের কি অবস্থা হয় সে কথা সকলেই জানে— আমান উল্লাও জানেন। তবে বল দেখি, তিনি কোন্ বুদ্ধিতে সুরাইয়াকে বল নাচে নিয়ে গেলেন? জলালাবাদের মত জংলী শহরেও দু-একখানা বিদেশী খবরের কাগজ আসে— তাতে ছবি বেরিয়েছে রানী পরপুরুষের গলা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সমস্ত ব্যাপারটা যে কতদূর মারাত্মক আমান উল্লা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি তার মাপেরেছেন, তিনি আমান উল্লাকে পীড়াপীড়ি করছেন সুরাইয়াকে তালাক দেবার জন্য।