মৌলানা বললেন, সায়েব, বড় বেঁচে গেছেন; গাঁয়ের লোক যে আপনার গলা কেটে গাজী হবার লোভ সম্বরণ করতে পেরেছে, সেই আমাদের পরম সৌভাগ্য।
বেনওয়া বললে, চেষ্টা হয়নি কি না বলতে পারব না। যখনই দেখেছি দুতিনজন মিলে ফিসফাস করছে, তখনই সন্দেহ করেছি, আমাকে নিয়েই বুঝি কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস বাড়ি ওয়ালা আমাকে অতিথি হিসেবে ধরে নিয়ে আমার প্রাণ বাঁচানো নিজের কর্তব্য বিবেচনা করে আর পাঁচজনকে ঠেকিয়ে রেখেছিল।
আমি বললুম, আমি কাবুলের গায়ে এক বছর কাটিয়েছি, আমার বিশ্বাস, কাবুল উপত্যকার সাধারণ চাষা অত্যন্ত নিরীহ। পারতপক্ষে খুন-খারাবি করতে চায় না।
বেনওয়া সাহেব বেশভূষা পরিবর্তন করে আপন লিগেশনে চলে গেলেন।
আমি মৌলানাকে বললুম, দেখলে? ফরাসী, জর্মন, রুশ, তুর্ক, ইরানী, ইতালী সবাই আপন আপন লিগেশনে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। শুধু তোমার আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই।
মৌলানা বললেন, বৃটিশ লিগেশন বৃটিশের জন্য বাঙলা কথা। যদিও লিগেশন তৈরী ভারতীয় অর্থে, চলে ভারতের পয়সায়, ইস্তক হিজ ব্রিটানিক ম্যাজেস্টিস মিনিস্টার লেফটেনান্ট কর্নেল স্যার ফ্রান্সিস হামফ্রিস মুন খান ভারত সরকারের।
আমি বললুম, বিস্তর মুন; মাসে তিন চার হাজার টাকার।
দুজনেই একবাক্যে স্বীকার করলুম যে, পরাধীন দেশে অবমাননা লাঞ্ছনা বিদেশ না গেলে সম্যক হৃদয়ঙ্গম হয় না।
জর্মন কবি গ্যোটে বলেছেন, যে বিদেশে যায়নি, সে স্বদেশের স্বরূপ চিনতে পারেনি।
৩৬. বাঘ হতে ভয়ঙ্কর অরাজক দেশ
চারদিন অরাজকতার ভিতর দিয়ে কাটল। কনফুৎসিয় বলেছেন, বাঘ হতে ভয়ঙ্কর অরাজক দেশ, আমি মনে মনে বললুম, তারও বাড়া যবে ডাকু পরে রাজবেশ।
আমান উল্লা বসে আছেন আর্কের ভিতরে। তাঁর চেলা-চামুণ্ডারা শহরের লোককে সাধ্যসাধনা করছে বাচ্চার সঙ্গে লড়াই করবার জন্য। কেউ কান দিচ্ছে না। শহর চোরভাকাতে ভর্তি। যেসব বাড়ি পাকাপোক্ত মাল দিয়ে তৈরী নয়, সেগুলো লুট হচ্ছে। একটুখানি নির্জন রাস্তায় যাবার যো নেই— ওভারকোটের লোভে শীত-কাতুরে ফিচকে ডাকাত সব কিছু করতে প্রস্তুত। টাকার চেয়েও ডাকাতের লোভ ঐ জিনিসের উপর কারণ টাকা দিয়েও কোনো কিছু কেনার উপায় নেই। হাট বসছে না বলে দুধ, মাংস, আলু, পেঁয়াজ কিছুই কেনা যাচ্ছে না। গম-ডালের মুদীও গঁাট হয়ে বসে আছে, দাম চড়বার আশায় কাবুল শহর বাকি দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।।
শ্বেতাঙ্গরা রাস্তায় বেরচ্ছে না; একমাত্র রুশ পাইলটরা নির্ভয়ে শহরের মাঝখান দিয়ে ভিড় ঠেলে বিমানঘাঁটিতে যাওয়া-আসা করছে। হাতে রাইফেল পর্যন্ত নেই, কোমরে মাত্র একটি পিস্তল।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হলুম খাস কাবুল বাসিন্দাদের ব্যবহার দেখে। রাইফেল ঝুলিয়েছে কাঁধে, বুলেটের বেল্ট বেঁধেছে কোমরে, কেউ পরেছে আড়াআড়ি করে পৈতের মত বুকের উপরে, কেউবা বাজুবন্ধ বানিয়ে বাহুতে, কেউ কাঁকন করে কজীতে, দু-একজন মল করে পায়ে।
যে অস্ত্র বিদ্রোহী, নরঘাতক, দস্যর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য দীন আফগানিস্থান নিরম্ন থেকে ক্রয় করেছিল, সে আজ অলঙ্কাররূপে ব্যবহৃত হল।
কিন্তু আশ্চর্য, নগরী রক্ষা করাতে এদের কোনো উৎসাহ নেই। দস্যু জয়লাভ করলে লুষ্ঠিত হবার ভয় নেই, প্রিয়জনের অপমৃত্যুর আশঙ্কা সম্বন্ধে এরা সম্পূর্ণ উদাসীন, সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তা এদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি।
মীর আসলম কানে কানে বললেন, তিনি খবর পেয়েছেন কাবুলের বড় বড় মহল্লার সর্দার আর বাচ্চার ভিতরে গোপনে বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে যে, কাবুলীরা যদি আমান উল্লার হয়ে না লড়ে, তবে বাচ্চা শহর লুট করবে না।
কথাগুলো যীশুখ্রীষ্টের করাঙ্গুলি হয়ে আমার অন্ধত্ব ঘুচিয়ে দিল। মীর আসলমের খবর সত্য বলে ধরে নিলে কাবুলবাসীর নির্বিকল্প সমাধির চূড়ান্ত সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু হায়, অস্ত্রবলে হীন অর্থসামর্থ্যে দীন যে রাজা শুদ্ধ সাহসের বলে বিশ্বরাজ ইংরেজকে পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করলেন, অনুর্বর অনুন্নত দেশকে যে রাজা প্রগতিপথে চালিত করবার জন্য আপন সুখশান্তি বিসর্জন দিলেন, বিশ্বের সম্মুখে যে নরপতি আপন দেশের মুখোজ্জল করলেন তাকে বিসর্জন করে কাবুলের লোক বরণ করল ঘৃণ্য নীচ দস্যকে? একেই কি বলে কৃতজ্ঞতা, নিমকহালালি?
তবে কি আমান উল্লা কাফির?
মীর আসলম গর্জন করে বললেন, আলবৎ না; যে-রাজা প্রজার ধর্মকর্মে হস্তক্ষেপ করেন না, নমাজ, রোজা যিনি বারণ করেননি, হজে যেতে জকাত দিতে যিনি বাধা দেননি, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মহাপাপ, তাঁর শত্রুর সঙ্গে যোগ দেওয়া তেমনি পাপ। পক্ষান্তরে বাচ্চায়ে সকাও খুনী ডাকাত ওয়াজিব-উল-কৎল, কতলের উপযুক্ত। সে কস্মিনকালেও আমীরউল-মুমিনীন (বাদশা) হতে পারে না।
মীর আসলম বহু শাস্ত্রে অগাধ পণ্ডিত। আমার বিবেকবুদ্ধিও তাঁর কথায় সায় দিল। তবু বললুম, কিন্তু আপনি আবার কবে থেকে আমান উল্লার খায়ের খা হলেন?
মীর আসলম আরো জোর হুঙ্কার দিয়ে বললেন, আমি যা বলেছি, তা সম্পূর্ণ নেতিবাচক। আমি বলি, আমান উল্লা কাফির নয়। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না-জায়িজ অশাস্ত্রীয়।
নাস্তিক রাশান রাজদূতাবাসে গিয়ে শুনি সেখানেও ঐ মত। দেমিফকে বললুম, রেভলিউশন আরম্ভ হয়েছে। তিনি বললেন, না, রেবেলিয়ন। আমি শুধালুম, তফাতটা কি? বললেন, রেভলিউশন প্রগতিকামী, রেবেলিয়ন প্রগতিপরিপন্থী।