অদৃষ্টের পরিহাস! আমান উল্লার পিতার নাম হবীব উল্লা। আততায়ীর হস্তে নিহত হবীব উল্লার অতৃপ্ত প্রেতাত্মা কি স্বীয় নামেই প্রতিহিংসার রক্ত অনুসন্ধান করছে।
সন্ধ্যার দিকে আবদুর রহমান তার শেষ বুলেটিন দিয়ে গেল। আমান উল্লার হাওয়াই জাহাজ কোনো গতিকে উঠতে পারায় বোমা ফেলেছে। বাচ্চার দল পালিয়ে গিয়ে মাইলখানেক দূরে থানা গেড়েছে।
৩৫. জনমানবহীন রাস্তা
জনমানবহীন রাস্তা। অথচ শান্তির সময় এ-রাস্তা গমগম করে। আমার গা ছমছম করতে লাগল।
দুদিকের দোকান-পাট বন্ধ। বসত-বাড়ির দেউড়ী বন্ধ। বাসিন্দারা সব পালিয়েছে না ঘুপটি মেরে দেয়ালের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, বোঝবার উপায় নেই। যে-কুকুর-বেড়াল বাদ দিয়ে কাবুলের রাস্তার কল্পনা করা যায় না, তারা সব গেল কোথায়? যেখানে গলি এসে বড় রাস্তায় মিশেছে, সেখানে ডাইনে-বাঁয়ে উঁকি মেরে দেখি একই নির্জনতা। এসব গলি শীতের দিনেও কাচ্চাবাচ্চার চিৎকারে গরম থাকে, মানুষের কানের তো কথাই নেই, বরফের গাদা পর্যন্ত ফুটো হয়ে যায়। এখন সব নিঝুম, নীরব। গলিগুলোর চেহারা এমনিতেই নোংরা থাকে, এখন জনমানবের আবরণ উঠে যাওয়াতে যেন সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সর্বাঙ্গের ঘা-পাঁচড়া দেখাতে আরম্ভ করেছে।
শহরের উত্তরপ্রান্ত। পর্বতের সানুদেশ। মৌলানার বাড়ি এখনো বেশ দূরে। বাচ্চার একদল ডাকাত এদিকে আক্রমণ করেছিল। তারা সব পালিয়েছে, না আড়ালে বসে শিকারের অপেক্ষা করছে, কে জানে?
হঠাৎ দেখি দূরে এক রাইফেলধারী। আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ডাইনে-বাঁয়ে গলি নেই যে, ঢুকে পড়ব। দাঁড়িয়ে অথবা পিছনে ফিরে লাভ নেই— আমি তখন মামুলী পাখী-মারা বন্দুকের পাল্লার ভিতরে। এগিয়ে চললুম। মনে হল রাইফেলধারীও আমাকে দেখতে পেয়েছে, কিন্তু আমাকে হাতিয়ারহীন দেখে কাঁধে ঝোলানো রাইফেল হাতে ভোলার প্রয়োজন বোধ করেনি। দুজনে মুখোমুখি হলুম, সে একবার আমার মুখের দিকে তাকালোও না। চেহারা দেখে বুঝলুম, সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তবে কি আমারই মত কারো সন্ধানে গিয়েছিল, নিরাশ হয়ে ফিরছে? কে জানে, কি?
মৌলানার বাড়ি গলির ভিতরে। সেখানে পৌঁছনো পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল না। কিন্তু এবারে নূতন বিপদ; দরজার কড়া নেড়ে নেড়ে হাতে কড়া পড়ে গেল— কোনো সাড়াশব্দ নেই। তবে কি মৌলানারা কেউ নেই? • অথবা সে শীতে দরজা-জানলা সব কিছু বন্ধু বলে কড়া নাড়া, আমার চীৎকার, কিছুই তাদের কানে পৌচ্ছে না। কতক্ষণ ধরে চেঁচামেচি করেছিলুম বলতে পারব না, হঠাৎ আমার মনে আরেক চিন্তার উদয় হল। মৌলানা যদি গুম হয়ে গিয়ে থাকেন, আর তার বউ বাড়িতে খিল দিয়ে বসে আছেন, স্বামীর গলা না শুনলে দরজা খুলবেন না; অথবা একা থেকে থেকে ভয়ে মূৰ্ছা গেছেন। আমার গলা থেকে বিকৃত চীৎকার বেরতে লাগল। নিজের নাম ধরে পরিচয় দিয়ে চেঁচাচ্ছি, মনে হচ্ছে, এ আমার গলা নয়, আমার নাম নয়।
হঠাৎ শুনি মেয়াও; জিয়াউদ্দীনের বেড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। মৌলানা। চোখ ফোলা, গাল এমনিতে ভাঙা আয় বসে গিয়েছে। দুদিনে দশ বছর বুড়িয়ে গিয়েছেন।
বললেন, পরশুদিন প্রথম গোলমাল শুরু হতেই চাকরকে টাঙা আনতে পাঠিয়েছিলেন, সে এখনো ফেরেনি। পাড়ার আর সবাই পালিয়েছে। ইতিমধ্যে বাচ্চার সেপাই দুবার এ-রাস্তা দিয়ে নেমে এসে দুবার হটে গিয়েছে। স্বামী-স্ত্রী আল্লার হাতে জান সঁপে দিয়ে ডাকাতের হানার অপেক্ষা করছিলেন।
সে তো হল। কিন্তু এখন চল। এই নির্জন ভূতুড়ে পাড়ায় আর এক মুহূর্ত থাকা নয়। তখন মৌলানা যা বললেন, তা শুনে বুঝলুম, এ সহজ বিপদ নয়। তার স্ত্রী আসন্নপ্রসবা। আমার বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যাবার মত অবস্থা হলে তিনি বহু পূর্বেই চলে আসতেন।
বললুম, তাহলে আর বসব না। টাঙার সন্ধানে চললুম।
শহরে ফিরে এসে পাক্কা দুঘণ্টা এ-আস্তাবল, সেবাগগীখানা অনুসন্ধান করলুম। একটা ঘোড় দেখতে পেলুম না; শুনলুম, ডাকাত এবং রেকুইজিশনের ভয়ে সবাই গাড়ি ফেলে ঘোড়া নিয়ে পালিয়েছে।
এখন উপায়? একমাত্র উপায় আবদুর রহমানের গায়ের জোর। সে মৌলানার বউকে কোলে-কাধে করে বাড়ি নিয়ে আসতে পারবে নিশ্চয়ই, কিন্তু। নাঃ, এতে কোনো কিন্তু নেই। রাজী করাতেই হবে।
কিন্তু বাড়ি ফিরে যে নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখলুম, তেমনটা জীবনে আর কখনো দেখিনি। আমার আঙ্গিনা যেন শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরি সামনের গৌর-প্রাঙ্গণ; বেনওয়া সায়েব আর মৌলানা নিত্যিকার মত পঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। আবদুর রহমানও সসম্ভ্রম গলা-খাঁকারি দিয়ে বোঝালো, পুরা বাধকে, জনানা হ্যায়।
জিয়াউদ্দীন বললেন যে, আমি চলে আসার ঘণ্টাখানেক পরেই নাকি তার চাকর টাঙা নিয়ে উপস্থিত হয়। আনন্দের আতিশয্যে প্রশ্ন পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলুম না, এ-দুর্দিনে সে টাঙা পেল কোথায়।
তারপর তাকিয়ে দেখি, বেনওয়া সায়েবের গালে দুদিনের দাড়ি, কোট-পাতলুন দুমড়ানো, চেহারা অধৌত। ভদ্রলোক ফরাসী, হামেশাই ফিটফাট থাকেন— শান্তিনিকেতনের সবাই জানে যে, বিদেশীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বাঙালী ফিট বাবুর মত ধুতি কুঁচিয়ে পরতে জানতেন, শুধু তাই নয়, বা-হাত দিয়ে কেঁচাটি টেনে নিয়ে খানিকটা উঁচুতে তুলে দরকার হলে হনহন করে হাঁটতেও পারতেন।
বললেন, পরশুদিন টাঙা ফরাসী লিগেশনে পৌঁছতে পারেনি লিগেশন শহরের উত্তরদিকে বলে পাগলা জনতা উজিয়ে গাড়ি খানিকটে চলার পর গাড়ি-গাড়োয়ান দুজন দিশেহারা হয়ে যায়। শেষটায় গাড়োয়ান সায়েবের কথায় কান না দিয়ে সোজা গ্রামের রাস্তা ধরে পুবদিকে তিন মাইল দূরে নিজের গাঁয়ে উপস্থিত হয়। সায়েব দুরাত্তির একদিন গরীব চাষার গোয়াল-ঘরে না আর কোথাও লুকিয়ে কাটিয়েছেন। দুচার ঘণ্টা অন্তর অন্তর নাকি গাড়োয়ান আর তার ভাই-বেরাদর গলার উপর হাত চালিয়ে সায়েবকে বুঝিয়েছে যে, কাবুল শহরের সব ফিরিঙ্গিকে জবাই করা হচ্ছে। বেনওয়া সায়েব ভালো সাহিত্যিক, কাজেই বর্ণনাটা দিলেন বেশ রসিয়ে রসিয়ে, আপন দুশ্চিন্তা-উদ্বেগটা ঢেকে চেপে, কিন্তু চেহারা দেখে বুঝতে পারলুম যে, ১৯১৪-১৮ সালের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার তুলনায় এ-অভিজ্ঞতার মূল্য তিনি কিছু কম দেননি।