তবে কি সেই বন্দুকগুলো নিয়েই বাচ্চার দল আমান উল্লাকে আক্রমণ করেছে? আশ্চর্য হবার কি আছে? আমান উল্লা যখন উপজাতিদের কাছ থেকে ভোলা ট্যাক্সের পয়সায় ফৌজ পুষে তাদের কাবুতে রাখেন তখন বাচ্চাই বা আমান উল্লার কাছ থেকে বন্দুক বাগিয়ে তাঁকে আক্রমণ করবে না কেন?
রাত তখন বারোটা। আবদুর রহমান বলল, আজ আমি আপনার বসবার ঘরে শোব।
আমি বললুম, তুমি তো ঠাণ্ডা ঘর না হলে ঘুমোত পারে না। আমার প্রাণ রক্ষার জন্য তোমাকে এত দুর্ভাবনা করতে হবে না।
আবদুর রহমান বলল, কিন্তু আমি অন্য ঘরে শুলে আমার বিপদ-আপদের খবর আপনি পাবেন কি করে? আমার জান বাবা আপনার হাতে সঁপে দিয়ে যাননি?
কথাটা সত্যি। আবদুর রহমান আমার চাকরীতে ঢুকেছে খবর পেয়ে তার বুড়া বাপ গাঁ থেকে এসে আমাকে তার জানের মালিক, স্বভাবচরিত্রের তদারকদার এবং চটে গেলে খুন করবার হক দিয়ে গিয়েছিল। আমি বুড়াকে খুশী করবার জন্য সিংহ ও মুষিকের গল্প বলেছিলুম।
কিন্তু আবদুর রহমানের ফন্দিটা দেখে অবাক হলুম। সাক্ষাৎ নিউটন। এদিকে বাক্সে দুটো ফুটো করে দুটো বেরালের জন্য, অন্য দিকে মাধ্যাকর্ষণতত্ত্বও আবিষ্কার করতে পারে— একদিকে কর্নেলের ছেলের ধাঁধায় বোকা বনে যায়, অন্য দিকে তর্কে বাঙালীকেও কাবু করে আনে।
আবদুর রহমান শুয়ে শুয়ে কতলে-আম্ অর্থাৎ পাইকারী খুনখারাবি লুটতরাজের যে বর্ণনা দিল তার থেকে বুঝলুম বাচ্চায়ে সকাও যদি শহর দখল করতে পারে তবে তার কোনোটাই বাদ যাবে না। চেঙ্গিস, নাদির রাজা-বাদশা হয়ে যখন এ সব করতে পেরেছেন তখন বাচ্চা ডাকাত হয়ে এ সব করবে না সে আশা দিদিমার রূপকথাতেও করা যায় না।
ইরান আফগানিস্থান চীন প্রভৃতি সভ্য দেশে সাজা দেওয়ার নানারকম বিদগ্ধ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া, কোমর অবধি মাটিতে পুঁতে চতুর্দিক থেকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করে মারা, পেট কেটে চোখের সামনে নাড়িভুড়ি বের করে করে মারা, জ্যান্ত অবস্থায় চামড়া তুলে মারা ইত্যাদি বহুতর কায়দায় অনেক চাক্ষুষ বর্ণনা আমি শুনেছি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে দেওয়ালের গায়ে দাড় করিয়ে লম্বা পেরেক দিয়ে দুকান দেওয়ালের সঙ্গে গেঁথে দেওয়া। আবদুর রহমানের কাছ থেকে শোনা, সে অবস্থায়ও নাকি মানুষের ঘুম পায় আর মাথা বার বার স্কুলে পড়ে। তার তুলনায় রাইফেল-মেশিনগানের শব্দ, আর চেঙ্গিস নাদিরের কাহিনীস্মরণ ধুলি পরিমাণ। কাজেই সেই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়াটা বীর অথবা কাপুরুষ কোনো কিছুরই লক্ষণ নয়।
সকাল বেলা দেউড়ি খুলে দেখি শহরে মেলার ভিড়। কাবুল শহরের আশপাশের গাঁ থেকে নানা রকম লোক এসে জড়ো হয়েছে, সুযোগসুবিধে পেলে লুটে যোগ দেবে বলে। অনেকের কাধেই বন্দুক, শীতের ভারী ভারী জামার ভিতর যে ছোরা পিস্তলও আছে সেটাও অনায়াসে বোঝা গেল। আবদুর রহমানের বাধা সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়লুম ব্যাপারটার তদারকতদন্ত করবার জন্য।
আর্ক কাবুল শহরের ভিতরকার বড় দুর্গ— হুমায়ুনের জন্ম এই আর্কের ভিতরেই হয়েছিল। আর্ক থেকে বড় রাস্তা বেরিয়ে এসে কাবুল নদীর পারে ঠেকেছে তাকেই কাবুলের চৌরঙ্গী বলা যেতে পারে। সেখানে দেখি একটা বড় রকমের ভিড় জমেছে। কাছে গিয়ে বুঝলুম কোনো এক বড় রাজকর্মচারী অফিসারও হতে পারেন–কাবুল শহরের লোকজনকে বাচ্চার বিরুদ্ধে লড়বার জন্য সলা-মন্ত্রণা দিচ্ছেন।
ওজার্ম সিতেআইয়াঁ–ধরো হাতিয়ার, ফ্রান্সের লোক, বাঁধো দল, বাঁধো দল ধরনের ওজস্বিনী ফরাসিনী বক্তৃতা নয়— ভদ্রলোকের মুখ শুকনো, ফ্যাকাশে ঠোঁট কাঁপছে আর বিড় বিড় করে যা বলছেন দশ হাত দূর থেকে তা শোনা যাচ্ছে না।
টিমের কাপ্তান যে রকম প্র্যাক্টিসের পূর্বে আঁটা আঁটা হকিষ্টিক বিলোয় তেমনি গাদা গাদা দামী দামী ঝকঝকে রাইফেল বিলোনো হচ্ছে। বলা নেই কওয়া নেই, যার যা ইচ্ছে এক একখানা রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। শুধু লক্ষ্য করলুম উত্তর দিকে কেউই গেল না– অথচ লড়াই হচ্ছে সেই দিকেই।
রাইফেল বিলোনো শেষ হতেই ভদ্রলোক তড়িৎ গতিতে চলে গেলেন। বিপজ্জনক অবশ্য কর্তব্য কর্ম অর্ধসমাধান করে মানুষ যে রকম তড়িঘড়ি অকুস্থান থেকে সরে পড়ে। তখন চোখে পড়ল তার পরনে পাজামা-কুর্তাজুব্বা-পাগড়ি দেরেশি নয়। তারপর চারদিকে তাকিয়ে দেখি কারো পরনেই দেরেশি নয়, আর সকলের মাথায়ই পাগড়ি। আমার পরনে সুট, মাথায় হ্যাট অস্বস্তি বোধ হতে লাগল।
এমন সময় দেখি ভিড় ঠেলে হন্ হন্ করে এগিয়ে আসছেন মীর আসলম। কোনো কথা না কয়ে আমার কাঁধে হাত দিয়ে আমাকে বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে চললেন— আমার কোনো প্রশ্নের উত্তরে মুখ না খুলে, কোনো কথায় কান না দিয়ে। বাড়ি পৌঁছতেই আমাদের দুজনকে দেখে আবদুর রহমান কি একটা বলে তিন লম্ফে বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরোল।
মীর আসলম আমাকে বলতে আরম্ভ করলেন। এ কি তামাশা দেখার সময়, না, ইয়ার্কি করে ঘুরে বেড়াবার মোকা। তাও আবার দেরেশি পরে।
আমি শুধু বললুম, কি করে জানব বলুন যে, দেরেশি পরার আইন মকুব হয়ে গিয়েছে।
মীর আসলম বললেন, মকুব বাতিলের প্রশ্ন এখন কে শুধায় বাপু। যে কোনো মুহূর্তে বাচ্চায়ে সকাও শহরে ঢুকতে পারে। কাবুলীরা তাই দেরেশি ফেলে ফের মুসলমান হয়েছে। দেখলে নাইস্তক সর্দার খান জোব্বা পরে রাইফেল বিলোলেন?