আমি কোনো গতিকে রাস্তা থেকে নেমে, নয়ানজুলি পেরিয়ে এক দোকানের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। স্থির করলুম, বিদ্রোহ বিপ্লবের সময় পাগলা ঘোড়ার চাট খেয়ে অথবা ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে মরব না; মরতে হয় মরব আমার হিস্যার গুলী খেয়ে।
এক মিনিট যেতে না যেতে আরেক ব্যক্তি এসে জুটলেন। ইনি ইটালিয়ান কলোনেল্লো অর্থাৎ কর্নেল। বয়স ষাটের কাছাকাছি, লম্বা করোগেটেড দাড়ি।
এই প্রথম লোক পেলুম যাকে ধীরেসুস্থে কিছু জিজ্ঞাসা করা যায়। বললুম, আমি তো শুনেছিলুম ডাকাত-সর্দার বাচ্চায়ে সকাও আসবে আমান উল্লার হয়ে শিনওয়ারীদের সঙ্গে লড়বার জন্য। কিন্তু এ কী কাণ্ড?
কলোনেল্লো বললেন, মনে হচ্ছে ভুল খবর। এ তো আসছে শহর দখল করবার জন্য।
তাই যদি হয় তবে আমান উল্লার সৈন্যেরা এখনো শহরের উত্তরের দিকে যাচ্ছে না কেন, এ রকম অতর্কিতে বাচ্চায়ে সকাও এসে পৌঁছলই বা কি করে, তার দলে কি পরিমাণ লোজন, শুধু বলুক না কামান-টামান তাদের সঙ্গে আছে–এ সব অন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর কলোনেল্লো দিতে পারলেন না। মাঝে মাঝে শুধু বলেন, কী অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
আমি বললুম, সাধারণ কাবুলী যে ভয় পেয়েছে সে তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু ইয়োরোপীয়ানরা এদের সঙ্গে জুটল কেন? এরা যাচ্ছে কোথায়?
কলোনেল্লো বললেন, আপন আপন রাজদূতাবাসে আশ্রয়ের সন্ধানে।
ততক্ষণে বন্দুকের আওয়াজ বেশ গরম হয়ে উঠেছে–ভিড়ও দেখলুম ঢেউয়ে ঢেউয়ে যাচ্ছে, একটানা স্রোতের মত নয়। দুই ঢেউয়ের মাঝখানে আমি কলোনেল্লোকে বললুম, চলুন বাড়ি যাই। তিনি বললেন যে, শেষ পর্যন্ত না দেখে তিনি বাড়ি যাবেন না। মিলিটারি খেয়াল, তর্ক করা বৃথা।
বাড়ির দোরের গোড়ায় দেখি আবদুর রহমান। আমাকে দেখে তার দুশ্চিন্তা কেটে গেল। বাড়ি ঢুকতেই সে সদর দরজা বন্ধ করে তার গায়ে এক গাদা ভারী ভারী পাথর চাপাল। বিচক্ষণ লোক, ইতিমধ্যে দুর্গ রক্ষা করার যে বন্দোবস্তের প্রয়োজন সেটুকু সে করে নিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, বেনওয়া সাহেব কোথায়? বললো, তিনি মাত্র একটি সুটকেশ নিয়ে টাঙ্গায় করে ফ্রেঞ্চ লিগেশনে চলে গিয়েছেন।
ততক্ষণে বন্দুকের শব্দের সঙ্গে মেশিনগানের একটানা ক্যাটক্যাট যোগ দিয়েছে। আবদুর রহমান চা নিয়ে এসেছিল। কান পেতে শুনে বলল, বাদশার সৈন্যেরা গুলী আরম্ভ করেছে। বাচ্চা মেশিনগান পাবে কোথায়?
আমি জিজ্ঞেস করলুম, বাদশার সৈন্যরা কি এতক্ষণে বাচ্চার মুখোমুখি হল? তবে কি সে বিনা বাধায় কাবুলে পৌঁছল?
আবদুর রহমান বলল, দোরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অনেককেই তো জিজ্ঞেস করলুম, কেউ কিছু বলতে পারল না। বোধ হচ্ছে বাচ্চা বিনা বাধায়ই এসেছে। ওর দেশ হল কাবুলের উত্তর দিকে, আমার দেশ পানশির— তারও উত্তরে। ওদিকে কোনো বাদশাহী সৈন্যের আনাগোনা হলে আমি দেশের লোকের কাছে থেকে বাজারে খবর পেতুম। বাদশাহী সৈন্যের সবাই তো এখন পুব দিকে শিনওয়ারীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছে— আলী আহমদ খানের বেতে।
গোলাগুলী চলল। সন্ধ্যা হল। আবদুর রহমান আমাকে তাড়াতাড়ি খাইয়েদাইয়ে আগুনের তদারকিতে বসল। তার চোখমুখ থেকে আন্দাজ করলুম, সে কাবুলীদের মত ভয় পায়নি। কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারলুম, বাচ্চা যদি জেতে তবে লুটতরাজ নিশ্চয় হবে এবং তাই নিয়ে আমার মঙ্গলামঙ্গল সম্বন্ধে সে ঈষৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। কিন্তু এ সব ছাপিয়ে উঠছে তার কৌতূহল আর উত্তেজনা শহরে সার্কাস ঢুকলে ছেলেপিলেদের যে রকম হয়।
কিন্তু এই বাচ্চায়ে সকাওটি কে? আবদুর রহমানকে জিজ্ঞেস করতে হল না, সে নিজের থেকেই অনেক কিছু বলল এবং তার থেকে বুঝলুম যে, আবদুর রহমান বরফের জহুরী, ফ্রস্টবাইটের ওঝা, রন্ধনে ভীমসেন, ইন্ধনে নলরাজ, সব কিছুই হতে পারেন, কিন্তু বসওয়েল হতে এখনো তার ঢের দেরী। বাচ্চায়ে সকাও সম্বন্ধে সে যা বলল তার উপরে উত্তম রবিন হুড খাড়া করা যায়, কিন্তু সে বস্তু জলজ্যান্ত মানুষের জীবনী বলে চালানো অসম্ভব।
চোদ্দ আনা বাদ দেওয়ার পরও যেটুকু রইল তার থেকে বাচ্চার জীবনের এইটুকু পরিচয় পাওয়া গেল যে, সে প্রায় শতিনেক ডাকাতের সর্দার, বাসস্থান কাবুলের উত্তরদিকে কুহিন্তানে, ধনীকে লুটে গরীবকে পয়সা বিলোয়, আমান উল্লা যখন ইউরোপে ছিলেন তার পরাক্রম তখন এমনি বেড়ে গিয়েছিল যে, কাবুলকুহিন্তানের পণ্য-বাহিনীর কাছ থেকে সে রীতিমত ট্যাক্স আদায় করত। আমান উল্লা ফিরে এসে কুহিন্তানের হাটে-বাজারে নোটিশ লাগান, ডাকাত বাচ্চায়ে সকাওয়ের মাথা চাই, পুরস্কার পাঁচ শ টাকা; বাচ্চা সেগুলো সরিয়ে পাল্টা নোটিশ লাগায়, কাফির আমান উল্লার মাথা চাই, পুরস্কার এক হাজার টাকা।
আবদুর রহমান জিজ্ঞেস করল, কর্নেলের ছেলে আমাকে শুধালো যে, আমি যদি আমান উল্লার মুণ্ডুটা কাটি, আর আমার ভাই যদি বাচ্চায়ে সকাওয়ের মুণ্ডুটা কাটে তবে আমরা দুজনে মিলে কত টাকা পাব। আমি বললুম, দেড় হাজার টাকা। সে হেসে লুটোপুটি; বলল, এক পয়সাও নাকি পাব না। বুঝিয়ে বলুন তো, হুজুর, কেন পাব না?
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, কেউ জ্যান্ত নেই বলে তোমাদের টাকাটা মারা যাবে বটে, কিন্তু কর্নেলের ছেলেকে বলল যে, তখন আফগানিস্থানের তখৎ তোমাদের পরিবারে যাবে।
আরো শুনলুম, বাচ্চায়ে সকাও নাকি দিন দশেক আগে হঠাৎ জবলুস-সিরাজের সরকারী বড় কর্তার কাছে উপস্থিত হয়ে কোরান ছুঁয়ে কসম খেয়েছিল যে, সে আমান উল্লার হয়ে শিনওয়ারীদের সঙ্গে লড়বে এবং সেই কসমের জোরে শখানেক রাইফেল তাঁর কাছ থেকে বাগিয়ে নিয়ে ফের উধাও হয়ে গিয়েছিল।