এবারে মোল্লারা যে মোক্ষম যুক্তি দেখাল তার বিরুদ্ধে কোনো শিনওয়ারী কোনো খুগিয়ানী একটি কথাও বলতে পারল না। মোল্লারা বলল, নিজের চোখে দেখিসনি আমান উল্লা গণ্ডা পাঁচেক কাবুলী মেয়ে মুস্তফা কামালকে ভেট পাঠিয়েছে; তারা যে একরাত জলালাবাদে কাটিয়ে গেল, তখন দেখিসনি, তারা বেপর্দা বেহায়ার মতন বাজারের মাঝখানে গটগট করে মোটর থেকে উঠল নামল?
কথা সত্যি যে, বিস্তর শিনওয়ারী খুগিয়ানী সেদিনকার হাটবারে জলালাবাদ এসেছিল ও সেখানে বেপর্দা কাবুলী মেয়েদের দেখেছিল। আরো সত্যি যে, গাজী মুস্তফা কামাল পাশা আফগান মোল্লাদের কাছ থেকে কখনো গুড কণ্ডাক্টের প্রাইজ পাননি।
তবু নাকি এক মূর্খ বলেছিল যে, মেয়েরা তুর্কী যাচ্ছে ডাক্তারি শিখতে। শুনে নাকি শিনওয়ারীরা অট্টহাস্য করেছিল— মেয়ে ডাক্তার! কে কবে শুনেছে মেয়েছেলে ডাক্তার হয়। তার চেয়ে বললেই হয়, মেয়েগুলো তুর্কীতে যাচ্ছে গোঁপ গজাবার জন্য।
কে তখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে যে, শিনওয়ারী মেয়েরাই বিনা পর্দায় ক্ষেতে-খামারে কাজ করে, কে বোঝাবে যে, বুড়ীদাদীমা যখন হলুদ-পট্টী বাঁধতে, কপালে জোঁক লাগাতে পুরুষের চেয়েও পাকাপোক্ত তখন কাবুলী মেয়েরাই বা ডাক্তার হতে পারবে না কেন? কিন্তু এ সব বাজে তর্ক, নিস্ফল আলোচনা। আসল একটা কারণের উল্লেখ কেউ কেউ করেছিলেন। কিন্তু সেটা কতদূর সত্য, অনুসন্ধান করেও জানতে পারিনি। আমান উল্লা নাকি রাজকোষের অর্থ বাড়াবার জন্য প্রতি আফগানের উপর পাঁচ মুদ্রা ট্যাক্স বসিয়েছিলেন।
আমান উল্লা এ সব কথাই আস্তে আস্তে জানতে পেরেছিলেন, কিন্তু আর পাঁচজনের মত তিনিও সেই ফার্সী বয়েৎটী জানতেন, সোনার রত্তিটুকু থাকলে মানুষ মরা কুকুরকেও আদর করে। আমান উল্লা সব উজিরদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, উপজাতিকে ঘুষ দেওয়ার ব্যাপারে কে কি জানেন?
আমার বন্ধু আধা-পাগলা দোস্ত মুহম্মদ ভুল বলেননি; দেখা গেল অনেকেই অনেক কিছু জানেন, শুধু জানেন না, কোন্ উপজাতির সঙ্গে কোন্ উপজাতির শত্রুতা, কোন্ উপজাতির বড় বড় সর্দার উপস্থিত কারা, কাদের মধ্যস্থতায় তাদের কাছে গোপনে ঘুষ পাঠানো যায়, কোন্ মোল্লার কোন্ খুড়ো উপস্থিত কাবুলে যে, তার উপর চোটপাট করলে দেশের ভাইপো শায়েস্তা হবেন অর্থাৎ জানবার মত কিছুই জানেন না।
তখন অনাদৃত উপেক্ষিত প্রাচীন ঐতিহ্যপন্থী বৃদ্ধদের ডাকা হল–তারা বললেন যে, গত দশ বৎসর ধরে তারা কোনো প্রকার কাজকর্মে লিপ্ত ছিলেন না বলে আফগান উপজাতিদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। রাজানুকম্পা বিগলিত হয়ে যে অর্থবারি তাদের পয়ঃপ্রণালী দিয়ে উপজাতিদের কাছে পৌঁছত, সে-সব পয়ঃপ্রণালী দশ বৎসরের অনাদরে জঞ্জালাবদ্ধ। এখন বন্যা ভিন্ন অন্য উপায় নেই।
অনেক ভেবে-চিন্তে আমান উল্লা তার ভগিনীপতি আলী আহমদ খানকে জলালাবাদ পাঠালেন। শিনওয়ারীদের টাকার বানে ভাসিয়ে দেবার জন্য সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, কেউ বলে দশ লাখ, কেউ বলে বিশ লাখ।
শাস্ত্রের তর্কে, দর্শনের লড়াইয়ে দিশেহারা হলে ওমর খৈয়াম মৃৎপাত্র ভরে সুরা পান করতেন। সেই মাটির ভাড়ই নাকি তখন তাকে গভীরতম সত্যের সন্ধান দিত।
আমার মৃৎপাত্র আবদুর রহমান। তাকে সব খুলে বলে তার মতামত জানতে চাইলুম। গোড়ার দিকে সে আমাকে রাজনৈতিক আলোচনা করতে বারণ করত, কিন্তু শিনওয়ারী বিদ্রোহের পাকাপাকি খবর শহরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজার গল্প গল্পের রাজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুর রহমান বরফের জহুরী, আর সেই বরফই তার মাপকাঠি। সে বলল, নানা লোকে নানা কথা কয়, তার হিশেব-নিকেশ আমি করব কি করে? কিন্তু একটা কথা ভুলবেন না, হুজুর, এই বরফ ভেঙে শিনওয়ারীরা কিছুতেই কাবুল পৌঁছতে পারবে না। ওদের শীতের জামা নেই। বরফ গলুক, তারপর দেখা যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলুম, তাই বুঝি প্রবাদ, কাবুল স্বর্ণহীন হোক আপত্তি নেই, কিন্তু বরফহীন যেন না হয়।
ভেবে দেখলুম আবদুর রহমান কিছু অন্যায় বলেনি। ইতিহাসে দেখেছি, বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দেশের বিদ্রোহবিপ্লবও ছেড়া কাঁথা গায়ে টেনে দিয়ে নিদ্রা যায় মনের হরিষে।
৩৪. এমন সময় যা ঘটল
এমন সময় যা ঘটল তার জন্য কেউ তৈরী ছিলেন না; প্রবীণ অর্বাচীন কারো কোনো আলোচনায় আমি এ ব্যাপারের কোনো আভাস ইঙ্গিত পাইনি।
বেলা তখন চারটে হবে। দোস্ত মুহম্মদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় তুমুল কাণ্ড। দোকানীরা দুদ্দাড় করে দরজাজানলা বন্ধ করছে, লোকজন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটোছুটি করছে, চতুর্দিকে চিৎকার, ও ভাই কোথায় গেলি, ও মামা শিগগির এসো। লোকজনের ভিড়ের উপর দিয়ে টাঙ্গাওয়ালারা খালি গাড়ি, বোঝাই গাড়ি এমনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে চালিয়েছে যে, আমার চোখের সামনে একখানা গাড়ি হুড়মুড়িয়ে কাবুল নদীর বরফের উপর গিয়ে পড়ল, কেউ ফিরে পর্যন্ত তাকাল না।
সব কিছু ছাপিয়ে মাঝে মাঝে কানে চিৎকার পৌঁছয়, বাচ্চায়ে সকাও আসছে, বাচ্চায়ে সকাও এসে পড়ল। এমন সময় গুড়ম করে রাইফেলের শব্দ হল। লক্ষ্য করলুম শব্দটা শহরের উত্তর দিক থেকে এল। সঙ্গে সঙ্গে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য জনতা যেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল। যাদের হাতে কাঁধে বোঁচকা-বুচকি ছিল তারা সেগুলো ফেলে দিয়ে ছুটলো, একদল রাস্তার পাশের নয়ানজুলিতে নেমে গেছে, অন্য দল কাবুল নদীতে জমে-যাওয়া জলের উপর ছুটতে গিয়ে বারে বারে পিছলে পড়ছে। রাস্তার পাশে যে অন্ধ ভিখারী বসতে সে দেখি উঠে দাঁড়িয়েছে, ভিড়ের ঠেলায় এদিক ওদিক টাল খাচ্ছে আর দুহাত শূন্যে তুলে সেখানে যেন পথ খুঁজছে।