অথচ এরা সবাই ভদ্রসন্তান, দু পয়সা কামায়ও বটে। বাড়িতে নিশ্চয়ই পছন্দমাফিক পোলও-কালিয়া খায়। কিন্তু পাঠান জীবনের প্রধান আইন, একলা বসে নবাবী খানা খাওয়ার চেয়ে ইয়ারবক্সীর সঙ্গে শুকনো রুটি চিবনো ভালো। ওমর খৈয়ামও বলেছেন,
তব সাথী হয়ে দগ্ধ মরুতে
পথ ভুলে তবু মরি।
তোমারে ছাড়িয়ে মসজিদে গিয়া
কী হবে মন্ত্র স্মরি?
কিন্তু ওমর বুর্জুয়া কবির বিদগ্ধ পদ্ধতিতে আপন বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। পাঠান ভাঙা ভাঙা উদুতে ঐ একই আপ্তবাক্য প্রলেতারিয়া কায়দায় জানায়–
দোস্ত!
তুমহারী রোটি, হমারা গোস্ত!
অর্থাৎ নেমন্তন্ন করেছ সেই আমার পরম সৌভাগ্য। শুধু শুকনো রুটি? কুছ পরোয়া নাহী। আমি আমার মাংস কেটে দেব।
কাব্যজগতে যে হাওয়া বইছে, তাতে মনে হয়, ওমরের শরাবের চেয়ে মজুরের ধেনোর কদর বেশী।
তবে একটা কথা বলে দেওয়া ভালো। পাঠানের ভিতর বুর্জুয়া প্রলেতারিয়ায় যে তফাৎ, সেটুকু সম্পূর্ণ অর্থ নৈতিক। অনুভূতির জগতে তারা একই মাটির আসনে বসে, আর চিন্তাধারায় যে পার্থক্য সে শুধু কেউ খবর রাখে বেশী, কেউ কম। কেউ সেক্সপীয়র পড়েছে, কেউ পড়েনি। ভালোমন্দ বিচার করার সময় দুই দলে যে বিশেষ প্রভেদ আছে, মনে হয়নি। আচার-ব্যবহারে এখনো তারা গুষ্ঠির ঐতিহ্যগত সনাতন জান-দেওয়া-নেওয়ার পন্থা অনুসরণ করে।
এসব তত্ত্ব আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন ইসলামিয়া কলেজের এক অধ্যাপক। অনেকক্ষণ ধরে নানা রঙ, নানা দাগ কেটে সমাজতাত্ত্বিক পটভূমি নির্মাণ করে বললেন–
এই ধরুন আমার সহকর্মী অধ্যাপক খুদাবখশের কথা। ইতিহাসে অগাধ পণ্ডিত। ইহসংসারে সব কিছু তিনি অর্থনীতি দিয়ে জলের মত তরল করে এই তৃষ্ণার দেশে অহরহ ছেলেদের গলায় ঢালছেন। ধর্ম পর্যন্ত বাদ দেন না। যীশু খ্রীস্ট তার ধর্ম আরম্ভ করেছিলেন ধনের নবীন ভাগবণ্টনপদ্ধতি নির্মাণ করে; তাতে লাভ হওয়ার কথা গরীবেরই বেশী তাই সবচেয়ে দুঃখী জেলেরা এসে জুটেছিল তাঁর চতুর্দিকে। মহাপুরুষ মুহম্মদও নাকি সুদ তুলে দিয়ে অর্থবণ্টনের জমিকে আরবের মরুভূমির মত সমতল করে দিয়েছিলেন। এসব তো ইহলোকের কথা–পরলোক পর্যন্ত খুদাবখশ অর্থনৈতিক বাঁদা চালিয়ে চিকণ মসৃণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু থাক এসব কচকচানি মোদ্দা কথা হচ্ছে ভদ্রলোক ইতিহাসের দূরবীনে আপন চোখটি এমনি চেপে ধরে আছেন যে অন্য কিছু তার নজরে পড়ে কিনা সে বিষয়ে আমাদের সকলের মনে গভীর সন্দেহ ছিল।
মাসখানেক পূর্বে তার বড় ছেলে মারা গেল। ম্যাটিক ক্লাশে পড়ত, মেধাবী ছেলে, বাপেরই মত পড়াশুনায় মশগুল থাকত। বড় ছেলে মারা গিয়েছে, চোট লাগার কথা, কিন্তু খুদাবখশ নির্বিকার। সময়মত কলেজে হাজিরা দিলেন। চায়ের সময় আমরা সন্তর্পণে শোক নিবেদন করতে গিয়ে আরেক প্রস্থ লেকচর শুনলুম, জরথুস্ত্র কোন্ অর্থনৈতিক কারণে রাজা গুশআপকে তার নূতন ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। তিন দিন বাদে দুসরা ছেলে টাইফয়েডে মারা গেল–খুদাবখশ বৌদ্ধ ধর্মের কি এক পিটক, না খোদায় মালুম কি, তাই নিয়ে বাহ্যজ্ঞানশূন্য। এক মাস যেতে না যেতে স্ত্রী মারা গেলেন পিত্রালয়ে-খুদাবখশ তখন সিন্ধুর পারে পারে সিকন্দর শাহের বিজয়পন্থার অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধানে নাককান বন্ধ করে তুরীয়ভাব অবলম্বন করেছেন।
আমরা ততদিনে খুদাবখশের আশা ছেড়ে দিয়েছি। লোকটা ইতিহাস করে করে অমানুষ হয়ে গিয়েছে এই তখন আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আর পাঠানসমাজ যখন মনুষ্যজাতির সর্বোচ্চ গৌরবস্থল তখন আর কি সন্দেহ যে খুদাবখশের পাঠানত্ব সম্পূর্ণ কপূর হয়ে গিয়ে তার ঐতিহাসিক টেলিস্কোপের পাল্লারও বহু উধ্বে দূরদূরান্তরে পঞ্চেন্দ্ৰিয়াতীত কোন্ সূক্ষ্মলোকে বিলীন হয়ে গিয়েছে।
এমন সময় মারা গেল তাঁর ছোট ভাই— পল্টনে কাজ করত। খুদাবখশের আর কলেজে পাত্তা নেই। আমরা সবাই ছুটে গেলুম খবর নিতে। গিয়ে দেখি এক প্রাগৈতিহাসিক ছেড়া গালচের উপর খুদাবখশ গড়াগড়ি দিচ্ছেন। পুথিপত্র, ম্যাপ, কম্পাস চতুর্দিকে ছড়ানো। গড়াগড়িতে চশমার একটা পরকলা ভেঙে গিয়েছে। খুদাবখশের বুড়া মামা বললেন, দুদিন ধরে জল স্পর্শ করেননি।
হাউ হাউ করে কাঁদেন আর বলেন, আমার ভাই মরে গিয়েছে। শোকে যে মানুষ এমন বিকল হতে পারে পুর্বে আর কখনো দেখিনি। আমরা সবাই নানারকমের সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু খুদাবখশের মুখে ঐ এক কথা, আমার ভাই মরে গিয়েছে।
শেষটায় থাকতে না পেরে আমি বললুম, আপনি পণ্ডিত মানুষ, শোকে এত বিচলিত হচ্ছেন কেন? আর আপনার সহ্য করবার ক্ষমতা যে কত অগাধ সে তো আমরা সবাই দেখেছি— দুটি ছেলে, স্ত্রী মারা গেলেন, আপনাকে তো এতটুকু কাতর হতে দেখিনি।
খুদাবখশ আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু মুখে কথা ফুটল। বললেন, আপনি পর্যন্ত এই কথা বললেন? ছেলে মরেছিল তো কি? আবার ছেলে হবে। বিবি মরেছেন তো কি? নূতন শাদী করব। কিন্তু ভাই পাব কোথায়? তারপর আবার হাউ হাউ করে কাঁদেন আর বলেন, আমার ভাই মরে গিয়েছে।
অধ্যাপক বলা শেষ করলে আমি বললুম, লক্ষ্মণের মৃত্যুশোকে রামচন্দ্রও ঐ বিলাপ করেছিলেন।
আহমদ আলী বললেন, লছমন্? রামচন্দরজী? হিন্দুদের কি একটা গল্প আছে? সেইটে আমাদের শুনিয়ে দিন। আপনি কখনো গল্প বলেন না, শুধু শোনেনই।
ইয়া আল্লা! আদি কবি বাল্মীকি যে গল্প বলেছেন আমাকে সে গল্প নূতন করে আমার টোটাফুটা উর্দু দিয়ে বলতে হবে! নিবেদন করলুম, অধ্যাপক খুদাবখশকে অনুরোধ করবেন। রামায়ণের নাকি অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাও আছে।