কিন্তু তিনি তখন এমনি আত্মকতৃত্ব হারিয়ে বসেছেন যে, তাঁকে ঠেকানো মুশকিল। কখনও বলেন, শিনওয়ারীরা বর্বর জানোয়ার কখনো বলেন, সাত দিন ধরে সরকারী কোনো খবর পাওয়া যায়নি, কখনো বলেন, শিনওয়ারীরা শহরে পৌঁছলে কোনো অফিসার পরিবারের রক্ষা নেই।
জলালাবাদ অঞ্চলে লুঠতরাজ হচ্ছে আগেই গুজব হিসেবে শুনেছিলুম; তার সঙ্গে এসব ছেড়াছেড়া খবর জুড়ে দিয়ে বুঝতে পারলুম যে, সে অঞ্চলে শিনওয়ারীরা বিদ্রোহ করে কাবুলের দিকে রওয়ানা হয়েছে, আমান উল্লা তাদের ঠেকাবার জন্য যে ফৌজ পাঠিয়েছিলেন সাতদিন ধরে তাদের সম্বন্ধে কোনো বিশ্বাস্য খবর পাওয়া যায়নি, আর কাবুলের অফিসার-মহলে গুজব, সে বাহিনীর অফিসাররা শিনওয়ারীদের হাতে ধরা পড়েছেন।
এত বড় দুঃসংবাদ ইংরিজী পড়ার চেষ্টা দিয়ে দমন করা অসম্ভব। আর আমি এসব সংবাদ জেনে ফেলেছি সেটাও কত্ৰী আদপেই পছন্দ করছিলেন না। কিন্তু কর্নেলের বউকে তিনি কিছুতেই ঠেকাতেও পারছিলেন না। শেষটায় আমি এক রকম জোর করে ওঠবার চেষ্টা করলে কর্নেলের বউ হঠাৎ চোখ মুছে বললেন, না, মুআল্লিম সাহেব, আপনি যাবেন না, আমি পড়াতে মন দিচ্ছি।
এ রকম পড়া আমাকে যেন জীবনে আর না পড়াতে হয়। এবার যখন ভেঙ্গে পড়লেন, তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, বাদশা আমান উল্লার মত যারা গোপ রেখেছে তাদের ধরে ধরে উপরের ঠোঁট কেটে ফেলছে। আমান উল্লা ঠিক নাকের তলায় একটুখানি গোঁফ রাখেন–সেই টুথব্রাশ মুস্টাশ ফ্যাশান ফৌজী অফিসারদের ভিতর ছড়িয়ে পড়েছিল।
এবারে আমি একটু সান্ত্বনা দেবার সুযোগ পেলুম। বললুম, লড়াইয়ের সময় কত রকম গুজব রটে সে সব কি বিশ্বাস করতে আছে? আপনি অধীর হয়ে পড়েছেন তাই অমঙ্গল সংবাদ মাত্রই বিশ্বাস করছেন।
আবার চোখ মুছে উঠে বসলেন। আমি যে পর-পুরুষ সে কথা ভুলে গিয়ে হঠাৎ আমার দুহাত চেপে ধরে বললেন, মুআল্লিম সায়েব, সত্যি বলুন, ইমান দিয়ে বলুন, আপনি কয় সপ্তাহ ধরে হিন্দুস্থানের চিঠি পাননি?
হিন্দুস্থানের ডাক শিনওয়ারী অঞ্চল হয়ে কাবুলে আসে। তিন সপ্তাহ ধরে সে ডাক বন্ধ ছিল।
আমি উঠে দাঁড়ালুম। তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বললুম, আমি এ সপ্তাহেই দেশের চিঠি পেয়েছি।
তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন দেখে আমি বললুম, আপনি তো আর পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে মেশেন না যে, হক খবর পাবেন। মেয়েরা স্বভাবতই একটুখানি বেশী ভয় পায়, আর নানারকম গুজব রটায়। তাই তো বাদশাহ আমান উল্লা পরদা পছন্দ করেন না।
কর্ত্রী আমার সঙ্গে সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এসে বললেন, যে সব খবর শুনলেন সেগুলো আর কাউকে বলবেন না।
আমি বললুম, এসব খবর নয়, গুজব। গুজব রটালে শুধু কি আপনাদের বিপদ? আমি বিদেশী, আমাকে আরো বেশী সাবধানে থাকতে হয়।
রাস্তায় বেরিয়ে একা হতেই বুঝলুম, মিথ্যা সান্ত্বনা দেবার বিড়ম্বনাটা কি। সেটা কাটাবার জন্য পাঞ্জাবী গ্রামোফোনওলার দোকানে ঢুকলুম। আমার গ্রামোফোন নেই, আমি রেকর্ড কিনিনে তবু দেশের ভাই শুকুর মুহম্মদ বলে দোকানদার আমাকে সব সময় আদর-আপ্যায়ন করত। জিজ্ঞেস করলুম, মৌলানার বাঙলা রেকর্ডগুলো কলকাতা থেকে এসেছে?
দোকানদার বলল না, এবং ভাবগতিক দেখে বুঝলুম খোঁচাখুচি করলে কারণটা বলতেও তার বাধবে না। আমি কিন্তু তাকে না ঘাঁটিয়েই খানকয়েক রেকর্ড শুনে বাড়ি চলে এলুম।।
কিন্তু ঘাটাঘাটি খোঁচাখুচি কিছুই করতে হল না। স্তরে স্তরে বরফ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম গুজব এসে কাবুলের বাজারে ভূপীকৃত হতে লাগল। সে-বাজার অন্ন বিক্রয় করে অর্থের পরিবর্তে, কিন্তু সন্দেশ দেয় বিনামূল্যে এবং বিনামূল্যের জিনিস যে ভেজাল হবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে? খবরের চেয়ে গুজব রটল বেশী।
কিন্তু এ-বিষয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ রইল না যে, আমান উল্লা অস্ত্রবলে বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হননি, এখন যদি অর্থবলে কিছু করতে পারেন।
পূর্বেই বলেছি আফগানিস্থানের উপজাতি উপজাতিতে খুনোখুনি লড়াই প্রায় বারোমাস লেগে থাকে। সন্ধির ফলে কখনো কখনো অস্ত্রসংবরণ হলেও মিত্ৰতাহৃদ্যতার অবকাশ সেখানে নেই। কাজেই আফগান কূটনীতির প্রথম সূত্র : কোনো উপজাতি যদি কখনো রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তবে তৎক্ষণাৎ সেই উপজাতির শত্রুপক্ষকে অর্থ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে। যদি অর্থে বশ না হয়, তবে রাইফেল দেবে। রাইফেল পেলে আফগান পরমোৎসাহে শত্রুকে আক্রমণ করবে–কাষ্ঠ-রসিকেরা বলেন সে আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য বন্দুকগুলোর তাগ পরীক্ষা করা।
কিন্তু এস্থলে দেখা গেল, বিদ্রোহের নীল-ছাপটা তৈরী করেছেন মোল্লারা এবং তারা একথাটা সব উপজাতিকে বেশ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যদি কোনো উপজাতি কাফির আমান উল্লার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তবে তারা তখন দীন ইসলামের রক্ষাকর্তা। রাইফেল কিম্বা টাকার লোভে অথবা ঐতিহ্যগত সনাতন শত্রুতার স্মরণে তখন যারা আমান উল্লার পক্ষ নিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়বে তারাও তখন আমান উল্লার মতই কাফির। শুধু যে তারাই তখন দোজখে যাবে তা নয়, তাদের পূর্বতন অধস্তন চতুর্দশ পুরুষ যেন স্বর্গদ্বার দর্শন করবার আশা মনে পোষণ না করে।
এ বড় ভয়ঙ্কর অভিসম্পাত। ইহলোকে বক্ষলগ্ন থাকবে রাইফেল, পরলোকে হুরী, এই পুরুষ-প্রকৃতির উপর আফগান-দর্শন সংস্থাপিত। কোনোটাতেই চোট লাগলে চলবে না। কিন্তু প্রশ্ন আমান উল্লা কি সত্যই কাফির?