রাস্তায় বেরিয়ে দেখি শহর অন্যদিনের তুলনায় ফাঁকা। দেরেশির অভাবে লোকজন বাড়ি থেকে বেরতে পারেনি। পর্দা তুলে দেওয়াতে যেমন রাস্তাঘাটে মেয়েদের ভিড় বাড়ার কথা ছিল তেমনি দেরেশির রেওয়াজ এক নূতন ধরনের পর্দা হয়ে পুরুষদের হারেমবন্ধ করল।
যারা বেরিয়েছে তাদের দেরেশির বর্ণনা দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। যত: রকম ছেড়া, নোংরা, শরীরের তুলনায় হয় ছোট নয় বড়, কোট-পাতলুন, প্লাস-ফোর্স, ব্রিচেস দিয়ে যত রকমের সম্ভব অসম্ভব খিচুড়ি পাকানো যেতে পারে তাই পরে কাবুল শহর রাস্তায় বেরিয়েছে গোটা দশেক পাগলাগারদকে হলিউডের গ্রীনরুমে ছেড়ে দিলেও এর চেয়ে বিপর্যয় কাণ্ড সম্ভবপর হত না।
ইয়োরোপীয়রা বেরিয়েছে তামাশা দেখতে। আমার লজ্জায় মাথা কাটা গেল। আফগানিস্থানকে আমি কখনো পর ভাবিনি।
শহরতলী দিয়ে আমাকে কাজে যেতে হয়। সেখানে দেখি আরো কঠোর দৃশ্য। গ্রামের লাকড়ীওলা, সজীওলা, আণ্ডাওলা যেই শহরের চৌহদ্দির ভিতরে পা দেয় অমনি পুলিশ তাদের ধরে ধরে এক এক পাই করে জরিমানা করে। বেচারীদের কোনো রসিদ দেওয়া হয় না; কাজেই দশ পা যেতে না যেতে তাদের কাছ থেকে অন্য পুলিশ এসে আবার নূতন করে জরিমানা আদায় করে। দুনিয়ার যত পুলিশ সেদিন কাবুলের শহরতলীতে জড়ো হয়েছে। খবর নিয়ে শুনলুম যারা এ সময়ে অফ-ডিউটি তারাও উর্দি পরে পয়সা রোজকার করতে লেগে গিয়েছে— জরিমানার পয়সা নাকি সরকারী তহবিলে জমা দেওয়ার কোনো বন্দোবস্ত করা হয়নি।
দিবাদ্বিপ্রহরে যে কাবুলী পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমনোতে রেকর্ড ব্রেক করতে পারে, তার ব্যস্ততা দেখে মনে হল, যেন তার বাস্তুবাড়িতে আগুন লেগেছে।
এ অত্যাচার কদিন ধরে চলেছিল বলতে পারিনে।
দুই সপ্তাহ ধরে দেশের খবরের কাগজ চিঠিপত্র পাইনি। খবর নিয়ে শুনলুম জলালাবাদ-কাবুলের রাস্তা বরফে ঢাকা পড়ায় মেল-বাস আসতে পারেনি; দু-একজন ফিসফিস করে বলল, রাস্তায় নাকি লুটতরাজও হচ্ছে। মীর আসলম সাবধান করে গেলেন যেন যেখানে সেখানে যা তা প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করি।
অন্য কাজ শেষ হলে মেয়েদের ইস্কুলের হেডমিস্ট্রেস ও সেকেণ্ড মিস্ট্রেসকে আমি ইংরিজী পড়াতুম। আফগান মেয়েরা চালাক; জানে যে, ধনীর কাছ থেকে টাকা বের করা শক্ত, কিন্তু গরীবের দরাজ-হাত। জ্ঞানের বেলাতেও এই নীতি খাটবে ভেবে এই দুই মহিলা আমাকেই বেছে নিয়েছিলেন।
হেড মিস্টেসের বয়স পঞ্চাশের উপর; মাতৃভাষা বাদ দিলে জীবনে তিনি এই প্রথম ভাষা শিখছেন। কাজেই কাবুলের পাথরফাটা শীতেও তাকে আমি ইংরিজী বানান শেখাতে গিয়ে ঘেমে উঠতুম। ইংরিজী ভাষা শিখতে বসেছেন, কিন্তু ঐ এক বিষয় ছাড়া দুনিয়ার আর সব জিনিষে তার কৌতূহলের সীমা ছিল না। বিশেষ করে মাস্টার মশায়ের বয়স কত, দেশ কোথায়, দেশের জন্য মন খারাপ হয় কিনা কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই তাঁর বাধতো না। তবে খুব সম্ভব আমার এপেনডিক্সের সাইজ ও এ-জগতে আমার জন্মাবার কি প্রয়োজন ছিল, এ দুটো প্রশ্ন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেননি। আমার উত্তর দেবার কায়দাও ছিল বিচিত্র। আমার দেশ? আমার দেশ হল Bengal বানানটা শিখে নিন, বি ই এন জি এ এল। উচ্চারণটাও শিখে নিন; কেউ বলে বেন্গোল, আবার কেউ বলে বেঙোল। ঠিক তেমনি France— এফ আর—। তিনি বলতেন, বুঝেছি, বুঝেছি, তা বলুন তো, বাঙালী মেয়েরা দেখতে কি রকম? শুনেছি তাদের খুব বড় চুল হয়, জুলফে-বাঙাল বলে একরকম তেল এদেশে পাওয়া যায়। আপনি কী তেল মাখেন? আমাদের দুজনার এই চাপান-উতোরের মাঝখানে পড়ে ইংরিজী ভাষা বেশী এগতে পারতো না, বিশেষ করে তিনি যখন আমাকে আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেন। মায়ের কথা বলার ফাঁকে ফাঁকি দিয়ে শটকে শেখাবার এলেম আমার পেটে নেই।
সেকেণ্ড মিস্টেসের বয়স কম— ত্রিশ হয় না হয়। দুটি বাচ্চার মা, থলথলে দেহ, খাঁদা নাক, মুখে এক গাদা হাসি, পরনে বারো মাস শ্লিপওভার, লম্বা-হাতা ব্লাউজ আর নেভি ব্লু ফ্রক। কর্নেলের বউ, বুদ্ধিশুদ্ধি আছে আর আমি যখন কর্ত্রীর প্রশ্নের চাপে নাজেহাল হতুম, তখন তিনি মিটমিটিয়ে হাসতেন আর নিতান্ত বেয়াড়া প্রশ্নে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলে মাঝে মাঝে উদ্ধার করে দিতেন।
জোর শীত কিন্তু তখনো বরফ পড়েনি এমন সময় একদিন পড়াতে গিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি কর্নেলের বউ বইয়ের উপর মুখ গুঁজে টেবিলে ঝুঁকে পড়েছেন আর কর্ত্রী তার পিঠে হাত বুলোচ্ছন। আমার পায়ের শব্দ শুনে কর্নেলের বউ ধড়মড় করে উঠে বসলেন। দেখি আর দিনের মত মুখের হাসির স্বাগতসম্ভাষণ নেই। চোখ দুটো লাল, নাকের ডগার চামড়া যেন ছড়ে গিয়েছে।
এসব জিনিষ লক্ষ্য করতে নেই। আমি বই খুলে পড়াতে আরম্ভ করলুম। দুমিনিটও যায়নি, হঠাৎ আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাঝখানে কর্নেলের বউ দুহাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। আমি চমকে উঠলুম। কর্ত্রী শান্তভাবে তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে থাকলেন, অধীর হয় না, অধীর হয়ে না। খুদাতালা মেহেরবান। বিশ্বাস হারিয়ো না, শান্ত হও।
আমি চোখের ঠারে কর্ত্রীকে শুধালুম, আমি তাহলে উঠি?
তিনি ঘাড় নেড়ে যেতে বারণ করলেন। দুমিনিট যেতে না যেতে আবার কান্না, আবার সান্ত্বনা; আমি যে সে অবস্থায় কি করব ভেবেই পাচ্ছিলুম না। কান্নার সঙ্গে মিশিয়ে যা বলছিলেন তার থেকে গোড়ার দিকে মাত্র এইটুকু বুঝলুম যে, তিনি তাঁর স্বামীর অমঙ্গল চিন্তা করে দিশেহারা হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ভালো করে কিছু বলতে গেলেই কর্ত্রী বাধা দিয়ে তাঁকে ওসব কথা তুলতে বারণ করছিলেন। বুঝলুম যে, অমঙ্গল চিন্তা সম্পূর্ণ অমূলক নয় এবং এমন সব কারণও তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে, সেগুলো প্রকাশ্যে বলা বাঞ্ছনীয় নয়।