মীর আসলম বললেন, গিন্নীকে গিয়ে বনু, ওগো চোখে সুরমা লাগিয়ে বে-বোরকায় কাবুল শহরে এট্টা রোদ মেরে এস। বিশ্বাস করবে না ভায়া, বদনা ছুঁড়ে মারলে। তা জানো তো, মোল্লার পাগড়ি, বদনাটাই খেল টোল। আম্মা অবশ্যি টাল খেয়ে খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম।
আমি বললুম, হাঁ হাঁ জানি, পাগড়ি অনেক কাজে লাগে।
মীর আসলম বললেন, ছাই জানো, বে করলে জানতে। বেয়াড়া বউকে তোমার তো আর বেঁধে রাখতে হয় না।
আমি বললুম, বাজে কথা। আমান উল্লা কাঁচ করে কেটে দিয়েছেন। আর ভালোই করেছেন, বউকে বেঁধে রাখতে হয় মনের শিকল দিয়ে, হৃদয়ের জিঞ্জির দিয়ে।
মীর আসলম বললেন, হৃদয়মনের কথা ওঠে যেখানে তরুণতরুণীর ব্যাপার। ষাট বছরের বুড়ো ষোল বছরের বউকে কোন্ মনের শেকল দিয়ে বাঁধতে পারে বলো? সেখানে কাবিননামা, সর্বাঙ্গ ঢাকা-বোরকা, আর পাগড়ির ন্যাজ।
আমি বললুম, তাতো বটেই।
মীর আসলম বললেন, আমান উল্লা যে পর্দা ছোড়ার জন্য তন্বী লাগিয়েছেন, তাতে জোয়ানদের কি? বেদনাটা সেখানে নয়। বুড়া সর্দারদের ভিতর চিংড়ি বউদের ঠেকাবার জন্য সামাল সামাল রব পড়ে গিয়েছে।
আমি শুধালুম, তরুণীরা চঞ্চল হয়ে উঠেছেন নাকি?
তিনি বললেন, ভ্যালা রে বিপদ, আমাকে তুমি নওরোজের আকবর বাদশা ঠাওরালে নাকি? চিংড়িদের আমি চিন কোত্থেকে? ইস্তক মেয়ে নেই, ছেলের বউও নেই। গিন্নীর বয়স পঞ্চাশ, কিন্তু বয়স পঁড়িয়ে হাফ-টিকিট কেটেছেন, দেখলে বোঝা যায় শ খানেক হবে।
আমি বললুম, তবে কি বুড়োরা খামকা ভয় পেয়েছেন?
মীর আসলম বললেন, শোনো। খুলে বলি। আমান উল্লার হুকুম শোনা মাত্র চিংড়িরা যদি লাফ দিয়ে উঠত, তবে বুড়োরাও না হয় তার একটা দাওয়াই বের করত; এই মনে করো তুমি যদি হঠাৎ তলোয়ার নিয়ে কাউকে হামলা করো, সেও কিছু একটা করবে। বীর হলে লড়বে, বকরীর কলিজা হলে ন্যাজ দেখাবে। কিন্তু এ তো বাপু তা নয়, এ হল মাথার ওপর ঝোলানো নাঙা তলোয়ার। চিংড়িরা হয়ত সব চুপ করে বসে আছে রাস্তায় তো এখনো চাদের হাট বসেনি কিন্তু এক একজন এক এক শ খানা তলোয়ার হয়ে চঁাদির ওপর ঝুলে আছেন। চোখ দুটি বন্ধ করে একটিবার দেখে নাও, বাপু।
শিউরে উঠলুম।
৩৩. এক অপরূপ মূর্তি
একদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতে দেখি চোখের সামনে। দাঁড়িয়ে এক অপরূপ মূর্তি। চেনা চেনা মনে হল অথচ যেন অচেনা। তার হাতের ট্রের দিকে নজর যেতে দেখি সেটা সম্পূর্ণ চেনা। তার উপরকার রুটি, মাখন, মামলেটু, বাসি কাবাবও নিত্যিকার চেহারা নিয়ে উপস্থিত। ধূম দেখলে বহ্নির উপস্থিতি স্বীকার করতেই হয়; সকালবেলা আমার ঘরে এ রকমের ট্রে হাওয়ায় দুলতে পারে না, বাহক আবদুর রহমানের উপস্থিতি স্বীকার করতে হয়।
কিন্তু কী বেশভূষা! পাজামা পরেনি, পরেছে পাতলুন। কয়েদীদের পাতলুনের মত সেটা নেমে এসেছে হাঁটুর ইঞ্চি তিনেক নিচে; উরুতে আবার সে পাতলুন এমনি টাইট যে, মনে হয় সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী নাইট সাটিনের ব্রিচেস্ পরেছেন। শার্ট, কিন্তু কলার নেই। খোলা গলার উপর একটা টাই বাঁধা। গলা বন্ধ কোট, কিন্তু এত ছোট সাইজের যে, বোম লাগানোর প্রশ্নই ওঠে না— তাই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শার্ট আর টাই। দুকান ছোঁয়া হ্যাট, ভুরু পর্যন্ত গিলে ফেলেছে। দোকানে যে রকম হ্যাট-স্ট্যাণ্ডের উপর খাড়া করানো থাকে।
পায়ে নাগরাই, চোখে হাসি, মুখে খুশী।
আবদুর রহমানের সঙ্গে এক বছর ঘর করেছি। চটে গিয়ে মাঝে মাঝে তাকে হস্তীর সঙ্গে নানাদিক দিয়ে তুলনা করেছি, কিন্তু সে যে সম্পূর্ণ সুস্থ, তার মাথায় যে ছিট নেই সে বিষয়ে আমার মনে দৃঢ়প্রত্যয় ছিল। তাই চোখ বন্ধ করে বললুম, বুঝিয়ে বল।
আমার যে খটকা লাগবে সে বিষয়ে সে সচেতন ছিল বলে বলল, দেরেশি পুশিদম–অর্থাৎ সুট পরেছি।
আমি শুধালুম, সরকারী চাকরী পেলে লোকে দেরেশি পরে; আমার চাকরী ছেড়ে দিচ্ছ নাকি?
আবদুর রহমান বলল, তওবা, তওবা, আপনি সায়েব আমার সরকার, আমার রুটি দেনেওয়ালা।
তবে?
সকালবেলা রুটি কিনতে গেলে পর পুলিশ ধরলো। বলল, বাদশার হুকুম আজ থেকে কাবুলের রাস্তায় পাজামা, কুর্তা, জোব্বা পরে বেরোনো বারণ— সবাইকে দেরেশি পরতে হবে। আমার কাছ থেকে এক পাই জরিমানাও আদায় করল। রুটি কিনে ফেরবার পথে আর দুতিনটে পুলিশ ধরল। আপনার দোহাই পেড়ে কোনো গতিকে বাড়ি ফিরেছি। বাড়ির সামনে আমাদের পড়শী কর্নেল সায়েবের সঙ্গে দেখা, তিনি ডেকে নিয়ে এই দেরেশি দিলেন, আমাকে তিনি বড্ড স্নেহ করেন কিনা, আমিও তার ফাইফরমাশ করে দিই।
গুম হয়ে শুনলুম। শেষটায় বললুম, দর্জির দোকানে তো এখন ভিড় হওয়ার কথা। দুদিন বাদে গিয়ে তোমার পছন্দমত একটা দেরেশি করিয়ে নিয়ে।
আবদুর রহমান হিসেবী লোক; বলল, এই তো বেশ।
আমি বললুম, চুপ। আর দুপুরবেলা এক জোড়া বুট কিনে নিয়ো।
আবদুর রহমান কলরব করে বলল, না হুজুর তার দরকার নেই। পুলিশের ফিরিস্তিতে বুটের নাম নেই।
প্রথমটায় অবাক হলাম। পরে বুঝলুম ঠিকই তো; লক্ষ্মণ না হয় সীতাদেবীর পায়ের দিকে তাকাতে পারেন–রাজাপ্রজায় তো সে সম্পর্ক নয়!
বললুম, চুপ। দুপুর বেলা কিনবে। আর দেখো, এবার হ্যাটটা খুলে ফেলল।
আবদুর রহমান চুপ।
বললুম, খুলে ফেলল।
আবদুর রহমান আস্তে আস্তে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, হুজুরের সামনে? তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ মনে পড়ল উত্তর আফগানিস্থান তুর্কিস্থানে মানুষ শয়তানের ভয় পেলে পাগড়ি খুলে ফেলে। শুধু-মাথা দেখলে নাকি শয়তান পালায়। তাই আবদুর রহমান ফাঁপরে পড়েছে। তখন মনে পড়ল যে, হৌস অব কমন্সে হ্যাট না পরা থাকলে কথা কইতে দেয় না। বললুম, থাক তাহলে তোমার মাথার হ্যাট।