কিন্তু জেগে উঠেই মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন কি আহারের? রুটি আর কাবাবওয়ালার দোকানের সামনে কী অসম্ভব ভিড়। বোরকাপরা মেয়ে, সবে-হাঁটতে শিখেছে ছেলে, বাঁ হাত মরণের দিকে ডান হাত রুটিওয়ালার দিকে বাড়িয়ে বুড়ো, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে আহারের সন্ধানে। রুটিওয়ালা সেই ক্ষুধার্তদের শান্ত করার জন্য কাউকে কাতরকণ্ঠে ডাকে ভাই কাউকে বরাদর, কাউকে জানে মন্ (আমার জান্), কাউকে আগা-জা–পশতু, পাঞ্জাবী, ফরাসী, উর্দু চারটে ভাষায় সে একসঙ্গে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। ওদিকে তন্দুরের ভিতর লম্বা লোহার আঁকশি চালিয়ে রুটি টেনে টেনে ওঠাচ্ছে রুটিওয়ালার ছোকরা গনগনে আগুনের টকটকে লাল আভা পড়েছে তাদের কপালে গালে। বড় বড় বাবরীচুলের জুলফি থেকে থেকে চোখমুখ ঢেকে ফেলছে দুহাত দিয়ে রুটি তুলছে, সরাবার ফুরসুৎ নেই। বুড়ো রুটিওয়ালার দাড়ি হাওয়ায় দুলছে, কাজের হিড়িকে তার বাঁধন পাগড়ি পর্যন্ত টেরচা হয়ে একদিকে নেমে এসেছে ছছাকরাদের কখনও তম্বী করে জুদ কুন, জু কু জলদি করো, জলদি করো, খদ্দেরদের কখনও কাকুতি-মিনতি হে ভ্রাতঃ, হে বন্ধু, হে আমার প্রাণ, হে আমার দিলজান, সবুর করে, সবুর করে, তাজা গরম রুটি দি বলেই তো এত হাঙ্গাম-হুজ্জৎ। বাসী দিলে কি এতক্ষণ তোমাদের দাড় করিয়ে রাখতুম?
বোরকার আড়াল থেকে কে যেন বলল–বয়স বোঝার জো নেই–তোর তাজা রুটি খেয়ে খেয়েই তো পাড়ার তিনপুরুষ মরল। তুই বুঝি লুকিয়ে লুকিয়ে বাসী খাস। তাই দে না।
বোরকা পরে, ঐ যা। তা না হলে পাঠান মেয়েও স্বাধীন।
রুটির পর ফুল কিংবা আতর। মনে পড়ল মহাপুরুষ মুহম্মদের একটি বচন–সত্যেন দত্তের তর্জমা–
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি।
জুটে যায় যদি দুইটি পয়সা
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী।
০৫. পাঠান অত্যন্ত অলস এবং আড্ডাবাজ
পাঠান অত্যন্ত অলস এবং আড্ডাবাজ, কিন্তু আরামপ্রয়াসী নয় এবং যেটুকু সামান্য তার বিলাস, তার খরচাও ভয়ঙ্কর বেশী কিছু নয়। দেশভ্রমণকারী গুণীদের মুখে শোনা যে, যাদের গায়ের জোর যেমন বেশী, তাদের স্বভাবও হয় তেমনি শান্ত। পাঠানদের বেলায়ও দেখলুম কথাটা খাঁটি। কাগজে আমরা হামেশাই পাঠানদের লুটতরাজের কথা পড়ি তার কারণও আছে। অনুর্বর দেশ, ব্যবসাবাণিজ্য করতে জানে না, পল্টনে তো আর তামাম দেশটা ঢুকতে পারে না, কাজেই লুটতরাজ ছাড়া অন্য উপায় কোথায়? কিন্তু পেটের দায়ে যে অপকর্ম সে করে, মেজাজ দেখাবার জন্য তা করে না। তার আসল কারণ অবশ্য পাঠানের মেজাজ সহজে গরম হয় না— পাঞ্জাবীদের কথা স্বতন্ত্র। এবং হলেও সে চট করে বন্দুকের সন্ধান করে না। তবে সব জিনিসেরই দুটো একটা ব্যত্যয় আছে— পাঠান তো আর খুদ খুদাতালার আপন হাতে বানানো ফিরিস্তা নয়। বেইমান বললে পাঠানের রক্ত খাইবার পাসের টেম্পারেচার ছাড়িয়ে যায়, আর ভাইকে বাঁচাবার জন্য সে অত্যন্ত শান্তমনে যোগাসনে বসে আঙুল গোণে, নিদেনপক্ষে তাকে কটা খুন করতে হবে। কিন্তু হিসেবনিকেশে সাক্ষাৎ বিদ্যেসাগর বলে প্রায়ই ভুল হয় আর দুটো-চারটে লোক বেঘোরে প্রাণ দেয়। তাই নিয়ে তন্বীতম্ব করলে পাঠান সকাতর নিবেদন করে, কিন্তু আমার যে চার-চারটে বুলেটের বাজে খরচা হল তার কি? তাদের গুষ্ঠি-কুটুম কান্নাকাটি করছে, কিন্তু একজনও একবারের তরে আমার বাজে খরচার খেসারতির কথা ভাবছে না। ইনসান বড়ই খুদপরস্ত— সংসার বড়ই স্বার্থপর।
পরশু রাতের দাওয়াতে এ রকম নানা গল্প শুনলুম। এসব গল্প বলার অধিকার নিমন্ত্রিত ও রবাহুতদের ছিল। একটা জিনিসে বুঝতে পারলুম যে, এদের সকলেই খাঁটি পাঠান।
সে হল তাদের খাবার কায়দা। কার্পেটের উপর চওড়ায় দুহাত, লম্বায় বিশ-ত্রিশহাত প্রয়োজন মত একখানা কাপড় বিছিয়ে দেয়। সেই দস্তরখানের দুদিকে সারি বেঁধে এক সারি অন্য সারির মুখোমুখি হয়ে বসে। তারপর সব খাবার মাঝারি সাইজের প্লেটে করে সেই দস্তরখানে সাজিয়ে দেয়; তিন থালা আলু-গোন্ত, তিন থালা শিক-কাবাব, তিন থালা মুগী-রোস্ট, তিন থালা সিনাকলিজা, তিন থালা পোলাও, এই রকম ধারা সব জিনিস একখানা দস্তরখানের মাঝখানে, দুখানা দুই প্রান্তে। বাঙালী আপন আপন থালা নিয়ে বসে; রান্নাঘরের সব জিনিসই কিছু না কিছু পায়। পাঠানদের বেলা তা নয়। যার সামনে যা পড়ল, তাই নিয়ে সে সন্তুষ্ট। প্রাণ গেলেও কেউ কখনো বলবে না, আমাকে একটু মুর্গী এগিয়ে দাও, কিম্বা আমার শিক-কাবাব খাবার বাসনা হয়েছে। মাঝে মাঝে অবশ্যি হঠাৎ কেউ দরদ দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলে, আরে হোথায় দেখো গোলাম মুহম্মদ ঢাড়শ চিবোচ্ছে, ওকে একটু পোলাও এগিয়ে দাও না–সবাই তখন হাঁ-হাঁ করে সব কটা পোলাওয়ের থালা ওর দিকে এগিয়ে দেয়। তারপর মজলিস গালগল্পে ফের মশগুল। ওদিকে গোলাম মুহম্মদ শুকনো পোলাওয়ের মরুভূমিতে তৃষ্ণায় মারা গেল, না মাংসের থৈ-থৈ ঝোলে ডুবে গিয়ে প্রাণ দিল, তার খবর ঘণ্টাখানেক ধরে আর কেউ রাখে না। এবং লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, পাঠান আড্ডা জমাবার খাতিরে অনেক রকম আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত। গল্পের নেশায় বে-খেয়ালে অন্ততঃ আধ ডজন অতিথি সুদ্ধ শুকনো রুটি চিবিয়েই যাচ্ছে, চিবিয়েই যাচ্ছে। অবচেতন ভাবটা এই, পোলাওমাংস বাছতে হয়, দেখতে হয়, বহুৎ বয়নাক্কা, তাহলে লোকের মুখের দিকে তাকাব কি করে, আর না তাকালে গল্প জমবেই বা কি করে।