আমাকেই থামতে হল কারণ আহমদ আলী অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির লোক, কারো কথা মাঝখানে কাটেন না। আমি আটকে গেলে পর বললেন, থামলেন কেন, বলুন।
আমি বললুম, আপনারা কোন্ দুঃখে ইনিয়ে বিনিয়ে কাদবেন ম্যা ম্যা, মা মা করে।
আহমদ আলী বললেন, হু, এক জর্মন দার্শনিকও নাকি বলেছেন স্ত্রীলোকের কাছে যেতে হলে চাবুকটি নিয়ে যেতে ভুলে না।।
আমি বললুম, তওবা তওবা, অত বাড়াবাড়ির কথা হচ্ছে না।
আহমদ আলী বললেন, না, দাদা, প্রেমের ব্যাপারে হয় ইপার না হয় উপার। প্রেম হচ্ছে শহরের বড় রাস্তা, বিস্তর লোজন। সেখানে গোল্ডন মীন বা সোনালী মাঝারি বলে কোনো উপায় নেই। হয় কীপ টু দি রাইট অর্থাৎ ম্যা ম্যা করে হৃদয়বেদন নিবেদন, না হয়, লেফট অর্থাৎ বজ্রমুষ্টি দিয়ে নীটশে যা বলেছেন। কিন্তু থাক্ না এসব কথা।
বুঝলুম প্রেমের ব্যাপারে পাঠান নীরব কর্মী। আমরা বাঙালী, দুপুররাত্রে পাড়ার লোককে না জাগিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমালাপ করতে পারিনে। আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমাকে যেন খুশী করার জন্য আহমদ আলী বললেন, পেশাওয়ারের বাজারে কিন্তু কোনো গানেওয়ালী নাচনেওয়ালী ছমাসের বেশী টিকতে পারে না। কোনো ছোকরা পাঠান প্রেমে পড়বেই। তারপর বিয়ে করে। আপন গায়ে নিয়ে সংসার পাতে।
সমাজ আপত্তি করে না? মেয়েটা দুদিন বাদে শহরের জন্য কান্নাকাটি করে না?
সমাজ আপত্তি করবে কেন? ইসলামে তো কোনো মানা নেই। তবে দুদিন বাদে কান্নাকাটি করে কি না বলা কঠিন। পাঠান গাঁয়ের কান্না, শহরে এসে পৌঁছবে এত জোর গলা ইনজানেরও নেই। জানকী বাঈয়ের থাকলে আমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হতে হত না। হলপ করে কিছু বলতে পারব না, তবে আমার নিজের বিশ্বাস, বেশীর ভাগ মেয়েই বাজারের হট্টগোলের চেয়ে গ্রামের শান্তিই পছন্দ করে। তার উপর যদি ভালোবাসা পায়, তা হলে তো আর কথাই নেই।
আমি বললুম, আমাদের এক বিখ্যাত ঔপন্যাসিকও ঐ রকম ধরনের অভিমত দিয়েছেন, মেয়েদের বাজারে বহু খোঁজখবর নিয়ে।
এমন সময় আহমদ আলীর এক বন্ধু মুহম্মদ জান বাইসিকেল ঠেলে ঠেলে এসে হাজির। আহমদ আলী জিজ্ঞাসা করলেন, বাইসিকেল আবার খোঁড়া হল কি করে?
মুহম্মদ জান পাঞ্জাবী। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, কেন যে আপনি এদেশে এসেছেন বুঝতে পারিনে। এই পাঠানরা যে কি রকম পাব্লিক নুইসেন্স তার খবর জানতে পারতেন যদি একদিনও আধ ঘণ্টার তরে এ শহরে বাইসিকেল চড়তেন। এক মাইল যেতে যেতে তিনটে পাংকচার। সব ছোট ঘোট লোহার।
ভদ্রলোক দম নিচ্ছিলেন। আমি দরদ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, এত লোহা আসে কোথা থেকে?
মুহম্মদ জান আরো চটে গিয়ে বললেন, আমাকে কেন শুধচ্ছেন? জিজ্ঞেস করুন আপনার দিলজানের দোস্ত শেখ আহমদ আলী খান পাঠানকে।
আহমদ আলী বললেন, জানেন তো পাঠানরা বড় আড্ডাবাজ। গল্পগুজব না করে সে এক মাইল পথও চলতে পারে না। কাউকে না পেলে সে বসে যাবে রাস্তার পাশে। মুচীকে বলবে, দাও তো ভায়া, আমার পয়জারে গোটা কয়েক পেরেক ঠুকে। মুচী তখন ঢিলে লোহাগুলো পিটিয়ে দেয়, গোটা দশেক নূতনও লাগিয়ে দেয়। এই রকম শখানেক লোহা লাগালে জুতোর চামড়া আর মাটিতে লাগে না, লোহার উপর দিয়েই রাস্তার পাথরের চোট যায়। হাফসোল লাগানোর খরচাকে পাঠান বড় ভয় করে কিনা। সেই পেরেক আবার হরেক রকম সাইজের হয়। পাঠানের জুতো তাই লোহার মোজায়িক। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, লোহা ঠোকানো না-ঠোকানো অবান্তর–মুচীর সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্য ঐ তার অজুহাত।
মুহম্মদ জান বললেন, আর সেই লোহা ঢিলে হয়ে গিয়ে শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
আমি বললুম এতদিন আমার বিশ্বাস ছিল আড্ডা মানুষকে অপকর্ম থেকে ঠেকিয়ে রাখে। এখন দেখতে পাচ্ছি ভুল করেছি।
আহমদ আলী কাতরস্বরে বললেন, আড্ডার নিন্দা করবেন না। বাইসিকেল চড়ার নিন্দা করুন। আপনাকে বলিনি, অল অজলু মিনা শয়তান অর্থাৎ হন্তদন্ত হওয়ার মানে শয়তানের পন্থায় চলা। তাই তো বাইসিকেলের আরেক নাম শয়তানের গাড়ি।
সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেশাওয়ার দিনের ১১৪ ডিগ্রী ভুলে গিয়ে মোলায়েম বাতাস দিয়ে সর্বাঙ্গের গ্লানি খেদ ঘুচিয়ে দেয়। রাস্তাঘাট যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে হাইতুলে ঘোড়ার গাড়ির খটখটানি দিয়ে তুড়ি দিতে থাকে। পাঠান বাবুরা তখন সাজগোজ করে হাওয়া খেতে বেরোন। পায়ে জরীর পয়জার, পরনে পপলিনের শিলওয়ার–তার ভাজ ধারালো ছুরির মত ক্রীজের দুদিক বেয়ে কেতায় কেতায় নেমে এসেছে; মুড়ির ভিতরে লাল সুতোর গোলাপী আভা। গায়ে রঙীন সিল্কের লম্বা শার্ট আর মাথায় যে পাগড়ি তার তুলনা পৃথিবীর অন্য কোনো শিরাভরণের। সঙ্গে হয় না। বাঙালীর শিরাভরণ দেখে অভ্যাস নেই; টুপি বলুন, হ্যাট বলুন, সবই যেন তার কাছে অবান্তর ঠেকে, মনে হয় বাইরের থেকে জোর করে চাপানো, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও ধনী পাঠানের পাগড়ি দেখে মনে হয় ভগবান মানুষকে মাথাটা দিয়েছেন নিতান্ত ঐ পাগড়ি জড়াবার উপলক্ষ্য হিসাবে।
কামিয়ে-জুমিয়ে গোঁফে আতর মেখে আর সেই ভুবনমোহন পাগড়ি বেঁধে খানসাহেব যখন সাঁঝের ঝোঁকে পেশাওয়ারের রাস্তায় বেরোন, তখন কে বলবে তিনি জাকারিয়া স্ত্রীটের পাঠানের জাতভাই; কোথায় লাগে তাঁর কাছে তখন হলিউডের ঈভনিঙ ড্রেসপরা হীমেনদের দল?
ফুরফুরে হাওয়া গাছের মাথায় চিরুনি চালিয়ে, খানসায়েবদের পাগড়ির চুড়ো দুলিয়ে, ফুলের দোকানে ঝোলানো মালাতে কঁপন লাগিয়ে আর সর্বশেষে আহমদ আলীর দুকান-ছোঁয়া গোঁফে হাত বুলিয়ে নামল আমার শ্রান্ত ভালে— তপ্ত গ্রীষ্মের দগ্ধ দিনান্তের সন্ধ্যাকালে। এ যেন বাংলা দেশের জ্যৈষ্ঠশেষের নববর্ষণ— শীতল জলধারার পরিবর্তে এ যেন মাতৃহস্তের স্নিগ্ধমন্দ মলয়ব্যজন। কোন্ এক নৃশংস ফারাওয়ের অত্যাচারে দিবাভাগে দেশের জনমানব প্রাণীপতঙ্গ দলে দলে ভূগর্ভে আশ্রয় নিয়ে প্রহর গুণছিল, পশ্চিম-পিরামিডে তার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর বাতাস যেন মোজেসের অভয়বাণী দিয়ে গেল— দিকে দিকে নতুন প্রাণের সাড়া ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর।