আমি বললুম, সে না হয় আমার বেলা হতে পারত। কিন্তু আপনাকে তো রিপোর্ট দিতেই হত।
আহমদ আলী বললেন, তওবা, তওবা। আমি রিপোর্ট করতে যাব কেন? আমার কি দায়? গোরার রাইফেল, আফ্রিদীর তার উপর নজর। যে-জিনিসে মানুষের জান পোঁতা, তার জন্য মানুষ জান দিতে পারে, নিতেও পারে। আমি সে ফ্যাসাদে কেন ঢুকি? বাঙালী বোমা মারে কেন মারে খোদায় মালুম, রাইফেলে তো তার শখ নেই— ইংরেজ বোমা খেতে পছন্দ করে না কিন্তু বাঙালীর গোঁ সে খাওয়াবেই। তার জন্য সে জান দিতে কবুল, নিতেও কবুল। আমি কেন ইংরেজকে আপনার হাড়হদ্দের খবর দেব? জান লেনদেনের ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষের দূরে থাকা উচিত।
আমি বললুম, হক কথা বলেছেন। রাসেলেরও ঐ মত। ভ্যালুজ নিয়ে নাকি তর্ক হয় না। ইংরেজ পাঠানে বিস্তর মিল দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বাঙালী কেন বোমা মারে সে তো অত্যন্ত সোজা প্রশ্ন। স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতা পেয়ে গেলে সেটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাইফেলের প্রয়োজন হয়। তাই বোধ করি স্বাধীন আফ্রিদীর কাছে রাইফেল এত প্রিয়বস্তু।
আহমদ আলী অনেকক্ষণ আপন মনে কি যেন ভাবলেন। বললেন, কি জানি, স্বাধীনতা কিসের জোরে টিকে থাকে? রাইফেলের জোরে না বুকের জোরে। আমি এই পরশু দিনের একটা দাঙ্গার কথা ভাবছিলুম। জানেন বোধ হয়, পেশাওয়ারের প্রায় প্রতি পাড়ায় একজন করে গুণ্ডার সর্দার থাকে। দুই পাড়ার গুণ্ডার দলে সেদিন লাগল লড়াই। গোলাগুলীর ব্যাপার নয়।
০৪. যতই বলি
যতই বলি, ভাই আহমদ আলী, খুদা আপনার মঙ্গল করবেন, আখেরে আপনি বেহেশতে যাবেন, আমার যাওয়ার একটা বন্দোবস্ত করে দিন, আহমদ আলী ততই বলেন, বরাদরে আজীজে মন (হে আমার প্রিয় ভ্রাতা), ফার্সীতে প্রবাদ আছে, দের আয়দ্ দুরুস্ত আয়দ্ অর্থাৎ যা কিছু ধীরেসুস্থে আসে তাহাই মঙ্গলদায়ক; আরবীতেও আছে, অল অজলু মিনা শয়তান অর্থাৎ কিনা হন্তদন্ত হওয়ার মানে শয়তানের পন্থায় চলা; ইংরেজীতেও আছে—
আমি বললুম, সব বুঝেছি, কিন্তু আপনার পায়ে পড়ি এই পাঠানের চালে আমার চলবে না। শুনেছি এখান থেকে লাণ্ডিকোটাল যেতে তাদের পনরো দিন লাগে— বাইশ মাইল রাস্তা।
আহমদ আলী গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, কে বলেছে?
আমি বললুম, কেন, কাল রাত্তিরের দাওয়াতে, রমজান খান, সেই যে বাবরীচুলওয়ালা, মিষ্টি মিষ্টি মুখ।
আহমদ আলী বললেন, রমজান খান পাঠানদের কি জানে? তার ঠাকুরমা পাঞ্জাবী, আর সে নিজে লাহোরে তিন মাস কাটিয়ে এসেছে। খাস পাঠান কখনো আটক (সিন্ধু নদ) পেয়োয় না। তার লাণ্ডিকোটাল থেকে পেশাওয়ার পৌঁছতে অন্তত দুমাস লাগার কথা। না হলে বুঝতে হবে লোকটা রাস্তার ইয়ার-দোস্তের বাড়ি কাট করে এসেছে। পাঠানমুলুকের রেওয়াজ প্রত্যেক আত্মীয়ের বাড়িতে তেত্তির কাটান, আর, সব পাঠান সব পাঠানের ভাইবেরাদর। হিসেব করে নিন।
কাগজ পেন্সিল ছিল না। বললুম, রক্ষে দিন, আমার যে কণ্টাক্ট সই করা হয়ে গিয়েছে, আমাকে যেতেই হবে।
আহমদ আলী বললেন, বা না পেলে আমি কি করব?
আপনি চেষ্টা করেছেন?
আহমদ আলী আমাকে হুশিয়ার হতে বলে জানালেন, তিনি পুলিশের ইন্সপেক্টর, নানা রকমের উকিল মোক্তার তাকে নিত্যি নিত্যি জেরা করে, আমি ও-লাইনে কাজ করে সুবিধা করতে পারব না।
তারপর বললেন, পেশাওয়ার ভালো করে দেখে নিন। অনেক দেখবার আছে, অনেক শেখবার আছে। বোখারা সমরকন্দ থেকে সদাগরেরা এসেছে পুস্তীন নিয়ে, তাশকন্দ থেকে এসেছে সামোভার নিয়ে–
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, সামোভার কি?
রাশান গল্প পড়েন নি? সামোভার হচ্ছে ধাতুর পাত্র টেবিলে রেখে তাতে চায়ের জল গরম করা হয়। আপনারা যে রকম মিঙ বংশের ভাস নিয়ে মাতামাতি করেন, পেশাওয়ার কান্দাহার তাশকন্দ তুল্লা সামোভার নিয়ে সেই রকম লড়ালড়ি করে, কে কত দাম দিতে পারে। সে কথা আরেক দিন হবে। তারপর শুনুন, মজার-ই-শরীফ থেকে কার্পেট এসেছে, বদখশান থেকে লাল রুবি, মেশেদ থেকে তসবী, আজরবাইজান থেকে–
আমি বললুম, থাক থাক্।
আরো কত কি। তারা উঠেছে সব সরাইয়ে। সন্ধ্যাবেলায় গরম ব্যবসা করে, রাত্তিরে জোর খানাপিনা, গানবাজনা। কত হৈ-হল্লা, খুনখারাবী, কত রকম-বেরকমের পাপ। শোনেননি বুঝি, পেশাওয়ার হাজার পাপের শহর। মাসখানেক ঘোরাঘুরি করুন যে-কোনো সরাইয়ে ডজনখানেক ভাষা বিনা কসরতে বিনা মেহনতে শেখা হয়ে যাবে। পশতু নিয়ে আরম্ভ করুন, চট করে চলে যাবেন ফার্সীতে, তারপর জগতাইতুকী, মঙ্গোল, উসমানী, রাশান, কুদী–বাকিগুলো আপনার থেকেই হয়ে যাবে। গানবাজনায় আপনার বুঝি শখ নেই— সে কি কথা? আপনি বাঙালী, টাগোর সাহেবের গীতাঞ্জলি, গার্ডেনার আমি পড়েছি। আহা, কি উদা বয়েৎ, আমি ফার্সী তর্জমায় পড়েছি। আপনার হোত এসব জিনিসে শখ থাকার কথা। নাই বা থাকল, কিন্তু ইনজানের গান শুনে আপনি পেশাওয়ার ছাড়বেন কি করে? পেশাওয়ারী হুরী, বাবোটা ভাষায় গান গাইতে পারে। তার গাহক দিল্লী থেকে বাগদাদ অবধি। আপনি গেলে লড়কী বহুৎ খুশ হবে তার রাজত্ব বাগদাদ থেকে বাঙ্গাল অবধি ছড়িয়ে পড়বে।
আমি আর কি করি। বললুম, হবে, হবে। সব হবে। কিন্তু টাগোর সাহেবের কোন্ কবিতা আপনার বিশেষ পছন্দ হয়?
আহমদ আলী একটু ভেবে বললেন, আয় মাদর, শাহজাদা ইমরোজ—
বুঝলুম, এ হচ্ছে,
ওগো মা, রাজার দুলাল যাবে আজি মোর—
বললুম, সে কি কথা, খান সাহেব? এ কবিতা তো আপনার ভালো লাগার কথা নয়। আপনারা পাঠান, আপনারা প্রেমে জখম হলে তো বাঘের মত রুখে দাঁড়াবেন। ঘোড়া চড়ে আসবেন বিদ্যুৎগতিতে, প্রিয়াকে একটানে তুলে নিয়ে কোলে বসিয়ে চলে যাবেন দূরদূরান্তরে। সেখানে পর্বতগুহায় নির্জনে আরম্ভ হবে প্রথম মানঅভিমানের পালা, আপনি মাথা পেতে দেবেন তার পায়ের মখমলের চটির নিচে–